
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যের আকাশে বৃহস্পতিবার ঘটে গেল এক ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক বিমান দুর্ঘটনা, যা মুহূর্তেই কেড়ে নিয়েছে প্রায় তিন শতাধিক প্রাণ। সাড়ে তিন দশক পর দেশটির ইতিহাসে আরেকটি বিভীষিকাময় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা হিসেবে এটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এদিন আহমেদাবাদ শহর থেকে উড্ডয়ন করা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু, ধ্বংস আর শোকের এক ভয়াবহ চিত্র। এতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২৯৪ জন মানুষ। এই দুর্ঘটনায় গোটা ভারত থমকে গেছে।
নদীজুড়ে শুধু শোক
গুজরাটের তীর ঘেঁষা দুই বিখ্যাত নদী—নর্মদা ও তাপি—এখন যেন নিঃশব্দে কাঁদছে। এই নদীগুলো সাক্ষী হয়ে থাকল আরেকটি ভয়াল বিপর্যয়ের। চারদিকে এখন শুধু কান্না, শোক আর ধ্বংসস্তূপ। যাত্রী, পথচারী, হোস্টেলের ছাত্রছাত্রী—কেউই বাঁচলেন না এই দুর্ঘটনার ভয়াল গ্রাস থেকে।
১৯৯৬ সালের চরখি দাদরি দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি
এই বিমান দুর্ঘটনা ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ হিসেবে ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর হরিয়ানার চরখি দাদরিতে সৌদি ও কাজাখস্থানের দুটি যাত্রীবাহী বিমানের সংঘর্ষে ৩৪৯ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ২৯ বছর পর গুজরাটের এই মর্মান্তিক ঘটনা আবারও সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
কী ঘটেছিল বৃহস্পতিবার?
দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ব্রিটেনের লন্ডনের গ্যাটউইক অভিমুখে রওনা দেয় এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট AI-171। উড়োজাহাজটির গন্তব্য ছিল আট ঘণ্টার দূরত্বে, কিন্তু উড্ডয়নের মাত্র পাঁচ মিনিট পরই এটি মেঘানি এলাকার একটি মেডিকেল হোস্টেলের ওপর ভেঙে পড়ে।
বিমানটির পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন সুমিত সাবহারওয়াল এবং সহকারী পাইলট ক্লাইভ কুন্ডার। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গেই যান্ত্রিক গোলযোগ শুরু হয়। এমনকি সন্দেহ করা হচ্ছে, উড্ডয়নের সময় কিছু পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, যা বিমানের ইঞ্জিনে মারাত্মক ক্ষতি করে।
পাইলট শেষ মুহূর্তে বিমানটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, কিন্তু উচ্চতা অর্জনের আগেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেটি ৮২৫ ফুট উচ্চতা থেকে আছড়ে পড়ে শহরের জনবহুল এলাকায়। বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো এলাকা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ
দুর্ঘটনার পর পরই আহমেদাবাদ বিমানবন্দর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। স্থগিত রাখা হয়েছে সব ফ্লাইট। বিমানবন্দর ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো নিরাপত্তা ও উদ্ধার তৎপরতার স্বার্থে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
নিহত ও আহতদের মধ্যে কারা ছিলেন?
বিমানটিতে মোট ২৪২ জন যাত্রী ছিলেন, যাদের মধ্যে
-
৫৩ জন যুক্তরাজ্যের নাগরিক,
-
১৬৯ জন ভারতীয়,
-
৭ জন পর্তুগিজ,
-
১ জন কানাডিয়ান ছিলেন।
বিমানটি বিধ্বস্ত হয় একটি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর, ফলে বহু শিক্ষার্থীও নিহত হন। সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯৪ জনে, যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন যাত্রী, পাশাপাশি নিহত হয়েছেন হোস্টেলের অন্তত ৩৫ জন শিক্ষার্থী।
অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী
যেখানে ২৯৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, সেখানে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন একজন যাত্রী—বিশ্বাস কুমার রমেশ, যিনি ব্রিটিশ নাগরিক। তাঁর আসন নম্বর ছিল ১১-ই। দুর্ঘটনার পর তাঁকে আহত অবস্থায় নিজে হেঁটে বের হতে দেখা গেছে। তাঁর পরনে ছিল সাদা টি-শার্ট ও কালো ট্রাউজার্স, টি-শার্টে রক্তের দাগ এবং কপালে গভীর জখম ছিল। বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনাকে অবিশ্বাস্য এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যাতীত বলে আখ্যা দিয়েছেন।
রাজনীতিবিদও ছিলেন বিমানে
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নেমেছে শোকের ছায়া। কারণ বিমানটিতে ছিলেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানি। তিনি জেড-ক্লাসের যাত্রী ছিলেন এবং ব্যক্তিগত সফরে লন্ডনে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেছে এয়ার ইন্ডিয়ার একাধিক সূত্র।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “এই দুর্ঘটনার খবরে আমি শোকাহত ও স্তম্ভিত। ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এটি এক বিশাল জাতীয় বিপর্যয়।”
যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, “আহমেদাবাদের দুর্ঘটনার চিত্রগুলো অত্যন্ত বিধ্বংসী। ব্রিটিশ নাগরিকসহ সকল নিহতের পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা।”
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
-
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো বার্তায় বলেন,“এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমি গভীরভাবে শোকাহত। নিহতদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”
-
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পরিবার ও ভারতবাসী যেন এই শোক সইতে পারেন, সেই দোয়া করছি।”
-
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান তাঁর ফেসবুক বার্তায় বলেন, “এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোদের জন্য শোক ও তাদের পরিবারের জন্য গভীর সমবেদনা জানাই।”
ভারতের ইতিহাসে অন্যান্য বড় বিমান দুর্ঘটনা
সাল | স্থান | ঘটনা | নিহত |
---|---|---|---|
১৯৮৫ | আয়ারল্যান্ড উপকূলে | এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ (বোমা বিস্ফোরণ) | ৩২৯ |
১৯৯৬ | চরখি দাদরি | দুই বিমানের সংঘর্ষ | ৩৪৯ |
২০১০ | ম্যাঙ্গালুরু | রানওয়ে ছাড়িয়ে খাদে পড়ে | ১৫৮ |
২০২০ | কোঝিকোড় | অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে | ১৭ |
গুজরাটের আকাশে যে কালো ধোঁয়া উঠেছে, তা শুধু একটি বিধ্বস্ত বিমানের বার্তা বহন করছে না—বরং এটি বহন করছে শত শত পরিবারের চিরকালের কান্না। যারা হারিয়েছেন প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী, কিংবা সহকর্মী—তাদের জীবনে নেমে এসেছে এক অমোচনীয় শোক।
এই দুর্ঘটনা যেন আবারও বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, আধুনিক প্রযুক্তি আর উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থার পরও দুর্যোগ কখনও জানান দিয়ে আসে না। এটি মানুষকে অসহায় করে দেয়, আর ইতিহাসের পাতায় রক্তমাখা একটি নতুন অধ্যায় লিখে যায়।