
ছবি: সংগৃহীত
পবিত্র কুরবানির ঈদে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি করেন। কুরবানির পশুর গোশত নিয়ে বহু ধরনের প্রশ্ন উঠে আসে—কে খেতে পারবে, কে পাবে, বিক্রি করা যাবে কিনা, কীভাবে বণ্টন করতে হবে, এমনকি অমুসলিমদের দেওয়া যাবে কিনা। এসব প্রশ্নের উত্তর ইসলামী শরিয়তের নির্ভরযোগ্য ফতোয়া গ্রন্থগুলোতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। নিচে কুরবানির গোশত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধানসমূহ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
ইসলামী বিধান অনুযায়ী, কুরবানির পশুর গোশত তিন শ্রেণিতে বণ্টন করার নির্দেশনা রয়েছে—এক ভাগ নিজে ও পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য এবং বাকি এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের জন্য সদকা করা মুস্তাহাব। এটি কোনো বাধ্যতামূলক নিয়ম নয়, তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহিনদের আমল ও মতামতের ভিত্তিতে উত্তম ও প্রশংসিত বলে গণ্য হয়।
উল্লেখযোগ্য রেফারেন্স: ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৭৩
না, ইসলামে কুরবানির গোশত বিক্রি করা মাকরুহ তাহরিমি অর্থাৎ কঠিনভাবে অপছন্দনীয় এবং গোনাহের কাছাকাছি। কেউ যদি ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃতভাবে কুরবানির গোশত বিক্রি করে দেয়, তাহলে সেই টাকার পুরোটা সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
রেফারেন্স: ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৪৭৭
যদি গরু, মহিষ বা উটের মতো বড় পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরিক হয়, তবে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক যে, ওজনে মেপে সমানভাবে গোশত ভাগ করবে। অনুমাননির্ভর ভাগ করা জায়েজ নয়, কারণ এতে কারো ভাগে কম-বেশি পড়ে গেলে সেটা সুদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ হবে।
তবে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে—যদি ভাগ করার সময় কেউ মাথা, পা কিংবা চামড়া নেয়, এবং তার বিনিময়ে কিছু কম গোশত পায়, তবে সেটা জায়েজ হবে। কিন্তু কেউ যদি বেশি গোশতের সঙ্গে চামড়া কিংবা পা নেয়, তাহলে তা হবে সুদের শামিল এবং গোনাহগার হতে হবে।
রেফারেন্স: ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৩২
হ্যাঁ, ইসলামী শরিয়তে অমুসলিম প্রতিবেশী, সহকর্মী বা বন্ধুদের কুরবানির গোশত দেওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে মুসলিমদের অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম। ইসলামে মানবিক সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় এই ছাড় রয়েছে। তবে কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির গোশত, চামড়া বা রশি দেওয়া জায়েজ নয়।
রেফারেন্স: ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩০
না, শরিয়ত কঠোরভাবে নিষেধ করেছে কুরবানির পশুর কোনো অংশ—হোক সেটা গোশত, চামড়া, মাথা বা হাড়—কসাইয়ের পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়াকে। বরং তাকে অর্থ বা অন্য কোনো বস্তু দিয়ে আলাদা করে পারিশ্রমিক দেওয়া ওয়াজিব। অন্যথায় তা নিষিদ্ধ লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত হবে।
রেফারেন্স: ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৩৪
যদি কুরবানির বড় পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরিক হয়ে থাকে এবং তারা নিজেদের মধ্যে গোশত না ভাগ করে বরং তা একত্রে রান্না করে গরিব-মিসকিনদের খাওয়ায়, তাহলে সেটা জায়েজ। তবে শর্ত হলো, শরিকদের সবাই এতে সম্মত হতে হবে। যদি কোনো একজন শরিক আপত্তি করেন, তবে তা আর জায়েজ থাকবে না।
রেফারেন্স: মাসায়িলে ঈদাইন, পৃষ্ঠা ১৮৩
কসাইয়ের কাছে চামড়া বা রশি কমদামে বিক্রি করাও জায়েজ নয়, বিশেষ করে যদি তা কুরবানির খাতিরে কাটা হয়। চামড়ার প্রকৃত মূল্য অনুযায়ী সদকা করতে হবে। রশি সদকা করাও মুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, কুরবানির গোশত কি ফ্রিজে রেখে দীর্ঘদিন খাওয়া যাবে? হ্যাঁ, এটি সম্পূর্ণভাবে জায়েজ। হাদিসে তিন দিনের বেশি সময় কোরবানির গোশত জমিয়ে না রাখার যেসব নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা ছিল একটি নির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতির জন্য। এখন সেই নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়েছে, তাই সংরক্ষণে কোনো সমস্যা নেই।
কুরবানির গোশতের ব্যবস্থাপনায় ইসলামী শরিয়ত যেমন করুণাময় তেমনি অত্যন্ত সুবিন্যস্ত। এর মাধ্যমে শুধু একাকী পবিত্রতা অর্জন নয়, বরং সামাজিক সমতা, সৌহার্দ্য এবং সহানুভূতির অনুশীলন হয়। তাই শরিয়তের নির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে চলাই একজন মুসলমানের কর্তব্য। গোশত বিক্রির মতো নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থেকে বরং গরিবের মুখে হাসি ফোটানোই হবে প্রকৃত কুরবানির সফলতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ