
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪–২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে মূল্য সংযোজনের হার আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এই সময় ১০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়েছে ৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, ফলে প্রকৃত মূল্য সংযোজনের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশে।
এটি আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ২ দশমিক ১০ শতাংশ পয়েন্ট কম। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মূল্য সংযোজনের হার ছিল ৬১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ত্রৈমাসিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে তৈরি পোশাক খাতের এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে তুলা, সুতা, কাপড়, বোতাম, চেইন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাদ দিয়ে যে পরিমাণ আয় হয়, সেটিকেই ‘মূল্য সংযোজন’ হিসেবে গণ্য করেছে। এই পরিমাপকে অনেকেই প্রকৃত রপ্তানি আয় হিসেবেও বিবেচনা করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, মূল্য সংযোজনের এই হার কমে যাওয়া বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের কাঠামোতে এক ধরনের দুর্বলতা ও ঝুঁকি নির্দেশ করে। কারণ, পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস—দেশটির মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে।
পূর্ববর্তী হিসাব নিয়ে প্রশ্ন
এই খাতের পরিসংখ্যান নিয়ে পূর্বে বেশ কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের মধ্যে মারাত্মক গরমিল ধরা পড়ে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের তদন্তে দেখা যায়, ২০২১–২২ ও ২০২২–২৩ অর্থবছরে ইপিবি রপ্তানি আয়ের হিসাব কিছুটা বাড়িয়ে উপস্থাপন করেছিল, যার ফলে তৈরি পোশাক খাতে মূল্য সংযোজনের হারও কৃত্রিমভাবে উঁচু দেখানো হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২২–২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) হঠাৎ করে পোশাক খাতে মূল্য সংযোজনের হার ৫৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ইপিবি’র তথ্য খতিয়ে দেখে ও সংশোধন করে, তখন এই হার আবারও নেমে আসে ৬২ শতাংশে।
এমনকি ওই অর্থবছরের শেষ পাঁচটি প্রান্তিকে মূল্য সংযোজনের হার ৭০ থেকে ৭২ শতাংশ দেখানো হয়েছিল, যা পরে সংশোধন করে দেখা যায় বাস্তব হার ছিল ৫৭.৫ থেকে ৬১.৫ শতাংশের মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রতিটি প্রান্তিকেই এই হার ছিল নিম্নমুখী। চারটি প্রান্তিকে একটিও ৬২ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি, বরং কিছু প্রান্তিকে এটি ৫৭.৫ শতাংশে নেমে আসে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকেও সংকেত ছিল
বর্তমান ২০২৪–২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই মূল্য সংযোজনের হারে নিম্নগতি দেখা যাচ্ছিল।
প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ৯ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, যার বিপরীতে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ফলে ওই প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন দাঁড়ায় ৫৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রপ্তানি কিছুটা বেড়ে ১০ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় এবং আমদানি হয় ৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল। এতে ওই প্রান্তিকে কিছুটা উন্নতি ঘটলেও মূল্য সংযোজনের হার ৬১ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু তৃতীয় প্রান্তিকে আবারও পতনের ধারায় ফিরে গেছে এই হার।
কেন কমছে মূল্য সংযোজন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখনো আমদানি নির্ভর কাঁচামালের ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। তুলা থেকে শুরু করে সুতা, কাপড়, ডাই-কেমিক্যাল, এক্সেসরিজ—সবকিছুই বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়লে রপ্তানি আয়ে মূল্য সংযোজনের হার স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত সুতা ও কাপড় বর্তমানে চাহিদার ৩০ শতাংশ পূরণ করতে পারছে। বাকি ৭০ শতাংশই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
এছাড়া ডলারের উচ্চমূল্য এবং আমদানি জটিলতার কারণে অনেক সময় কারখানাগুলো উচ্চমূল্যে কাঁচামাল কিনতে বাধ্য হয়, যা তাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয় এবং মুনাফা কমিয়ে দেয়।
মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির জন্য কী করা দরকার?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন গার্মেন্ট খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ এবং কাঁচামাল উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছেন, “আমরা যদি সুতা ও কাপড়ের ওপর আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারি, তাহলে শুধু মূল্য সংযোজনই বাড়বে না, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ও হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকও এ লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে।
ভবিষ্যতের ঝুঁকি
বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশ এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রধান উৎস। এই খাতে মূল্য সংযোজন কমে যাওয়া মানে হলো—একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়া, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
এই পরিস্থিতি স্থায়ী হলে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা আরও গভীর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাফর উদ্দীন বলেন, “মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির চেয়ে বড় সংকেত হচ্ছে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পেছনে কৃত্রিম তথ্য প্রদর্শনের প্রবণতা। এটি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করতে পারে।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন ও আয়ের নিশ্চয়তা দিতে চাইলে এখনই আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে গুণগত উৎপাদন ও নিজস্ব কাঁচামাল সরবরাহে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নইলে আকারে বড় হলেও প্রকৃত আয় ক্রমাগত কমতেই থাকবে, যা অর্থনীতির জন্য এক বড় ঝুঁকির বার্তা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ