
ছবি: সংগৃহীত
সৌদি আরবে পবিত্র হজের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর আজ মঙ্গলবার (১০ জুন) থেকে শুরু হয়েছে বাংলাদেশি হাজিদের দেশে ফেরার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। চলতি বছরের হজ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ৮৭ হাজার ১৫৭ জন মুসল্লি হজ পালন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস সৌদি আরবে অবস্থান শেষে এখন তারা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সের যৌথ ব্যবস্থাপনায় আজ থেকে ফিরতি হজ ফ্লাইট শুরু হয়ে চলবে আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত।
হজ শেষে হাজিরা মিনায় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ, পশু কোরবানি, চুল কাটা ও ফরজ তাওয়াফ সম্পন্ন করেন। ফরজ তাওয়াফ বা বিদায়ী তাওয়াফ শেষে তারা ধীরে ধীরে মিনায় ফিরে যাচ্ছেন এবং সেখান থেকেই তাদের জেদ্দা বা মদিনা হয়ে দেশে ফেরা শুরু হচ্ছে। তবে কিছু হাজি মক্কায় অবস্থান করছেন তাওয়াফে বিদা ও অন্যান্য ইবাদত শেষ করার জন্য।
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর হাজিদের মাঝে দেখা দিয়েছে কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ। কিন্তু এ বিশ্রামের মধ্যেও অনেক হাজি মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। বিশেষ করে বয়স্ক হাজিদের অনেকেই মিনার তীব্র গরম ও ভিড়ের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে আশ্রয় নিয়েছেন মক্কায় অবস্থিত বাংলাদেশের হজ মিশনে। হজ মিশনের কর্মীরা জানান, প্রতিদিন অনেক পথভ্রষ্ট হাজিকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে এবং তাদের ওষুধ, খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ ব্যবস্থাপনা সেল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছর সৌদি আরবে অবস্থানরত অবস্থায় ১৯ বাংলাদেশি হজযাত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে, কেউবা হিটস্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ এবং ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে।
এ ছাড়া এ বছর সৌদি আরবে হজ পালনের সময় বাংলাদেশি হজযাত্রীদের মধ্যে অন্তত ১৮৮ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে বা হজ মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯ জন এখনও সৌদি আরবের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে হজ মিশন নিশ্চিত করেছে।
চলতি বছর হজ মৌসুমে সৌদি সরকার কড়াকড়িভাবে নজরদারি করে আসল ও ভুয়া হাজিদের মধ্যে পার্থক্য করেছে। হজের ভুয়া বা অনুমোদনহীন এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪৩৬টি ভুয়া হজ এজেন্সিকে বন্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে হজ সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে ৪৬২ জনকে আটক করেছে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী।
হজ মৌসুমে সৌদি আরবে অভ্যন্তরীণ তদারকির জন্য আলাদা হজ পুলিশ ইউনিট গঠন করা হয়, যারা ইলেকট্রনিক চিপ, স্মার্ট কার্ড এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে হাজিদের গতিবিধি নিরীক্ষণ করে। এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে অবৈধ হজযাত্রীদের চিহ্নিত করা হয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
চলতি বছর হজ অনুষ্ঠিত হয় ৫ জুন (৯ জিলহজ)। হজের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে হজ ফ্লাইট চালুর মাধ্যমে, যার প্রথম ফ্লাইট সৌদি আরবে যায় ২৯ এপ্রিল। হজযাত্রীদের শেষ ফ্লাইট ছিল ৩১ মে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ হজ অফিস, ধর্ম মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং হজ এজেন্সিগুলোর সমন্বয়ে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে যাত্রা এবং হজ পালনের জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যারা সৌদি আরবে এখনও অবস্থান করছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্ধারিত ফিরতি ফ্লাইটের অপেক্ষায় আছেন। মক্কা ও মদিনায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হজ মিশনের কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্যাম্প পরিদর্শন করে ফিরতি যাত্রার সময়সূচি, যানবাহন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছেন। হাজিদের পাসপোর্ট ও লাগেজ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে এবং তাদের নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট টিম কাজ করছে।
ফিরতি হজ ফ্লাইট চলাকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে হাজিদের জন্য বিশেষ ইমিগ্রেশন সহায়তা বুথ, চিকিৎসা সহায়তা ও লাগেজ হ্যান্ডলিং ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। হাজিদের যেন দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়, সেজন্য বসার ব্যবস্থা ও ঠান্ডা পানীয় সরবরাহের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
এদিকে সরকার এক অনুরোধবার্তায় বলেছে, হজের পর দেশে ফিরতে যাওয়া যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। বিশেষ করে কোভিড-১৯ ও অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি।
চলতি বছরের হজ কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ও চিকিৎসা জটিলতা দেখা দিয়েছে, তবে তা আগের বছরগুলোর তুলনায় কম। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিপুল সংখ্যক হাজিকে সঠিক সময়ের মধ্যে নিরাপদে দেশে ফেরানো। ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং আশা করা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব হাজি স্বদেশে ফিরতে পারবেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ