
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বিমান বাহিনীর টানা বোমাবর্ষণে গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত ৬০ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন আরও ৩৮৮ জন। ইসরাইলি বাহিনীর এ সামরিক অভিযানে দক্ষিণ গাজার রাফা অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত “গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন” (জিএইচএফ) এর সহায়তা কেন্দ্রের কাছেও প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৪ জন। সোমবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বাহিনীর বিমান ও স্থল অভিযানে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে, বিশেষ করে হাসপাতাল, স্কুল ও ত্রাণকেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় হামলার ঘটনা বেড়েছে।
গণহত্যার দ্বারপ্রান্তে গাজা, মৃত্যুর মিছিল ছুঁয়েছে ৫৫ হাজারের কাছাকাছি
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত ইসরাইলের চালানো হামলায় মোট প্রাণ হারিয়েছেন ৫৪ হাজার ৯২৭ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ২৬ হাজার ২২৭ জন। আহতদের বড় অংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ, যাদের অনেকেই যুদ্ধজনিত জটিলতা, খাদ্য ও ওষুধের সংকট এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন।
এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন গাজা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। হামলার অংশ হিসেবে তারা গুলি ও আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে অন্তত ১,২০০ জন ইসরাইলিকে এবং অপহরণ করে ২৫১ জনকে। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হামাসকে দমন এবং জিম্মিদের উদ্ধারের অজুহাতে গাজা জুড়ে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)।
প্রথম যুদ্ধবিরতির অবসান, নতুন করে আক্রমণ এবং দ্বিতীয় দফায় আরও ৪,৬০০ নিহত
টানা ১৫ মাস রক্তক্ষয়ী অভিযান চালানোর পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল ইসরাইল। তবে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই, ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইল আবারও গাজায় দ্বিতীয় দফায় সামরিক অভিযান শুরু করে। এই নতুন দফার অভিযানে ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন আরও ৪ হাজার ৬৪৯ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন প্রায় ১৪ হাজার ৫৭৪ জন।
এদিকে ইসরাইল দাবি করেছে, অপহৃত ২৫১ জন জিম্মির মধ্যে এখনও অন্তত ৩৫ জন জীবিত রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে আইডিএফ।
আন্তর্জাতিক নিন্দা ও আইনি পদক্ষেপ
ইসরাইলের এই রক্তক্ষয়ী অভিযানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহুবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এবং তা বন্ধের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে একাধিকবার যুদ্ধবিরতির পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, যদিও ইসরাইল তা উপেক্ষা করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)-এ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেখানে প্রমাণ হিসেবে গাজার হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ও খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্রে চালানো ইসরাইলি হামলার ভিডিও-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
তবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ ব্যাপারে একেবারে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস না করা এবং অপহৃতদের মুক্ত না করা পর্যন্ত গাজায় সামরিক অভিযান থামবে না। নেতানিয়াহুর ভাষায়, “গাজা একমাত্র তখনই শান্ত হবে, যখন হামাস নামক সন্ত্রাসী সংগঠনকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।”
শান্তি প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি নেই, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ঝুলে আছে
এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে গাজায় দুই মাসের একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনা দিয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে মানবিক ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে বন্দিবিনিময় ও চূড়ান্ত শান্তি আলোচনার পথ উন্মুক্ত হবে। যদিও ইসরাইল এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে, হামাস এখনো প্রস্তাবটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করেনি।
হামাসের এক মুখপাত্র আল-জাজিরাকে বলেছেন, “আমরা যুদ্ধবিরতি চাই, তবে সেটা ফাঁদে পড়ার জন্য নয়। আমাদের দাবি নিরপেক্ষ গ্যারান্টি, মানবিক করিডোর এবং গাজা থেকে ইসরাইলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার।”
মানবিক বিপর্যয়ের মুখে গাজাবাসী, সংকট দিনকে দিন গভীরতর
গাজার চরম মানবিক সংকটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়ে পড়েছে শিশু, নারী ও অসুস্থ জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বলছে, গাজায় প্রতিদিন গড়ে ২০০ শিশু অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে এবং ওষুধ, পানীয় জল ও বিদ্যুতের অভাবে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা ইতোমধ্যে ১৮ লাখ ছাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনই কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে গাজা বিশ্ব ইতিহাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে উঠবে। বিশ্ববাসীর চোখ এখন দুই পক্ষের অবস্থানের ওপর এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় কি না, সে দিকেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ