
ছবি: সংগৃহীত
চার দিনের সরকারি সফরে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক মহলে যেমন কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ করার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সফরকালে তিনি ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস এবং নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মিলিত হবেন।
সোমবার (১০ জুন) সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি। এ সময় তার সফরসঙ্গী হিসেবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও সঙ্গে রয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এ সময় তিনি রাজা চার্লসের হাত থেকে একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করবেন। এটি মূলত বিশ্ব শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রদান করা হয়।
ড. ইউনূসের এ সম্মাননা অর্জন কেবল ব্যক্তিগত গৌরব নয়, বরং এটি বাংলাদেশের জন্যও একটি আন্তর্জাতিক অর্জন বলে বিবেচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা যেমন পুনর্ব্যক্ত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের সদ্য পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আস্থা ও আগ্রহও প্রকাশ পাচ্ছে।
সফরকালে তিনি ২০২৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার–এর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক উত্তরণ, মানবাধিকার রক্ষা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া আলোচনায় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়—পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কৌশলগত সহযোগিতা—বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানানো হয়েছে। ব্রিটেনে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ শনাক্ত ও ফেরত আনার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন দ্বার খুলতে পারে এই আলোচনার মধ্য দিয়ে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিপ্রাপ্ত যুক্তরাজ্যের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস–এ অংশগ্রহণ। এখানে তিনি একটি উন্মুক্ত সংলাপে বক্তব্য রাখবেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকৌশল, নির্বাচনপূর্ব সংস্কার এবং ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিষয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, কূটনীতিক এবং গবেষকদের সামনে তুলে ধরবেন।
এই সংলাপটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেমন কভারেজ পাবে, তেমনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষত যুক্তরাজ্যের সমর্থন নিশ্চিত করা। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভঙ্গুর নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার যে রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া শুরু করেছে—তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে চান ড. ইউনূস।
তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ বিষয়ে কৌশলগত সহযোগিতা, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে কারিগরি সহায়তা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে পরামর্শ ও পরবর্তী সহযোগিতা প্রত্যাশা করবেন বলে জানা গেছে।
ড. ইউনূসের এই সফর কেবল একটি সম্মাননা গ্রহণের ভ্রমণ নয়; এটি বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। বিশেষ করে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, বিরোধী দলের আন্দোলন, নির্বাচনী ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ড. ইউনূসের এই সফর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটি বড় সুযোগ। একই সঙ্গে এ সফরটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি নতুন ধারা প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, লন্ডনে চার দিনব্যাপী সরকারি কর্মসূচি শেষ করে তিনি আগামী ১৪ জুন দেশে ফিরবেন। ফিরে আসার পর তিনি সফরের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বিস্তারিত জানাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সফর যে একান্ত কৌশলগত ও দূরদর্শী পদক্ষেপ—তা কূটনৈতিক বিশ্লেষকরাও স্বীকার করছেন। এখন দেখা যাক, এ সফর কতটা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে বাংলাদেশের জন্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ