
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসসহ ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে। এই আন্দোলন ইতোমধ্যে সহিংস রূপ নিয়েছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ, টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের ঘটনায় শহরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে অবশেষে বিক্ষোভ সামাল দিতে লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তায় নামানো হয়েছে মার্কিন সেনা বাহিনীর বিশেষ ইউনিট ‘মেরিন’ সেনাদের।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলেসের বিস্তৃত এলাকায় সরকারি স্থাপনা এবং ফেডারেল কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর এই অংশটি স্থানীয় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে কাজ করবে। সেনা মোতায়েনের এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে উঠেছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম।
গত শুক্রবার (৬ জুন) ক্যালিফোর্নিয়ার প্যারামাউন্ট ডিস্ট্রিক্টে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)–এর অভিযান থেকে উত্তেজনার সূত্রপাত। অভিবাসীবহুল এই এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ নথিপত্রহীন অভিবাসীদের গ্রেফতারে গেলে স্থানীয়রা আইসিই এজেন্টদের প্রতিরোধ করেন। মুহূর্তেই পরিস্থিতি বিক্ষোভে রূপ নেয়। এতে অংশ নেয় স্থানীয় লাতিন আমেরিকান জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ।
তাদের অভিযোগ, এই অভিযান বর্ণবাদী এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী কড়া অবস্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানায়। পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে শনিবার থেকেই, যখন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং পুলিশের যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
পুলিশের পক্ষে এককভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় মাঠে নামানো হয়েছে সেনা সদস্যদের। মার্কিন সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘টাস্ক ফোর্স ৫১’-এর আওতায় প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ১০০ জন ন্যাশনাল গার্ড সদস্য এবং ৭০০ জন মেরিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
এই বাহিনীকে ‘ভিড় নিয়ন্ত্রণ, উত্তেজনা প্রশমন এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের নীতিমালা’ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা পুলিশকে সহায়তা করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, সেনারা শুধুমাত্র ফেডারেল কর্তৃপক্ষের আওতায় নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করবে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম সেনা মোতায়েনের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি এটিকে ‘অযৌক্তিক এবং অপ্রয়োজনীয়’ পদক্ষেপ বলে আখ্যা দেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।
গতকাল সোমবার (৯ জুন) তিনি সানফ্রান্সিসকোর ফেডারেল আদালতে একটি মামলা করেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পুরো প্রতিরক্ষা বিভাগকে বিবাদী করা হয়েছে।
নিউসমের দাবি, রাজ্যের সম্মতি ছাড়াই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামোর পরিপন্থী। গভর্নর বলেন, “কোনো রাজ্যে ফেডারেল বাহিনী নামানোর আগে সেই রাজ্যের প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করা সংবিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত সরাসরি আমাদের রাজ্যীয় অধিকার লঙ্ঘন করেছে।”
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আন্দোলনকারীদের ‘চরমপন্থী এবং দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “দেশজুড়ে যদি প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যা করতে হয়, করব।”
তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ আরও একধাপ এগিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “ক্যাম্প পেন্ডলটনের মেরিন সেনারা পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে প্রয়োজনে কঠোরতম পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং সমাজকর্মীরা এই সেনা মোতায়েনকে ‘রাজনৈতিক দমনপীড়নের হাতিয়ার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার সংস্থা ACLU এক বিবৃতিতে জানায়, “এভাবে সেনাবাহিনী নামিয়ে সরকারের সমালোচকদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধাচরণ।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নভেম্বরের নির্বাচনের আগে অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়ে ভোটারদের মনোযোগ কাড়তে চাইছেন ট্রাম্প। তবে এই সিদ্ধান্ত তার জন্য রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলবে বলেও মত বিশ্লেষকদের।
লস অ্যাঞ্জেলেসে চলমান বিক্ষোভ এবং সেনা মোতায়েন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। অভিবাসন নীতি ও আইনের কঠোর বাস্তবায়ন বনাম মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার এই দ্বন্দ্বে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আরেক দফা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট, রাজ্য সরকার এবং জনগণের মধ্যে যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি কীভাবে সামাল দেওয়া যায় তার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ