
ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে নজিরবিহীন চাপের মুখে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআরকে এই মাসেই তুলতে হবে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর অর্থ, জুনের প্রতিটি কার্যদিবসে গড়ে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার রাজস্ব তুলতে হবে। এনবিআরের ইতিহাসে এর আগে কখনো এক মাসে এত বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের নজির নেই, ফলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ঘাটতির আশঙ্কা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত) প্রাথমিকভাবে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। তবে ভ্যাট রিটার্ন ও সংশোধিত হিসাব যোগ হলে এই অঙ্ক কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ শেষ মাসে তুলতে হবে অবশিষ্ট ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা প্রায় ৩১ শতাংশ।
মূল বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে বাস্তবতার নিরিখে তা ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু তাতেও লক্ষ্য পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে এনবিআরের ভেতরে-বাইরে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা।
একাধিক প্রতিকূলতা, পিছিয়ে পড়েছে রাজস্ব আদায়
রাজস্ব ঘাটতির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে এনবিআরের কর্মকর্তারা কয়েকটি প্রধান কারণ তুলে ধরেছেন। তাদের মতে—
রাজনৈতিক অস্থিরতা: গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন এবং ছাত্রদের বিভিন্ন কর্মসূচি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এতে রাজস্ব আদায়ের গতি শ্লথ হয়।
অর্থনৈতিক স্থবিরতা: মন্দাভাব, বিনিয়োগের গতি হ্রাস, এবং উৎপাদন খাতে সংকোচন রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধিকে বাঁধাগ্রস্ত করেছে। অনেকে বলছেন, ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট ও ভোক্তা ব্যয়ের নিম্নগতি ভ্যাট ও আয়কর উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আমদানি হ্রাস ও ডলার সংকট: ডলারের সংকটজনিত কারণে ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত কাঁচামাল বা পণ্য আমদানি করতে পারেননি, ফলে আমদানি শুল্কে বড় ধরনের ঘাটতি হয়েছে।
আয়কর খাতে ধীরগতি: দেশের করদাতার সংখ্যা ও কর আদায়ের দক্ষতার অভাবে প্রত্যাশিত হারে আয়কর আদায় হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, অনেক করদাতা রিটার্ন দাখিল করলেও সময়মতো কর পরিশোধ করেননি।
বিলুপ্তির দাবি ও অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ: এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কারের দাবি এবং সেটিকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব বিভাগ গঠনের প্রস্তাব ঘিরে কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চলমান অসন্তোষ কাজের গতিতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ঈদের ছুটিতে রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি আশঙ্কা
চলতি জুন মাসেই রয়েছে ঈদুল আজহার ছুটি। ঈদ উপলক্ষে সরকারি ছুটি মিলিয়ে প্রায় ১০ দিন এনবিআরের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ থাকবে। এতে কার্যত আদায়যোগ্য দিন থাকবে খুবই সীমিত। এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আহরণ বাস্তবসম্মত নয়।
এনবিআরের তথ্যমতে, মে মাস পর্যন্ত তিনটি প্রধান খাতে আদায় ছিল:
শুল্ক: ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট): ১ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা
আয়কর: ১ লাখ ৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা
এই তিনটি খাত মিলে মোট আদায় হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাকি ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা তুলতে হলে প্রতিটি দিনেই রেকর্ড ভাঙা আয় নিশ্চিত করতে হবে, যা অতীতে কখনো ঘটেনি।
বাস্তবতাবর্জিত লক্ষ্যমাত্রার অভিযোগ
এনবিআরের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিবছরই বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই চাপের ফলে বছরের শেষ দিকে প্রবল ঘাটতির মুখে পড়তে হয়, যা বাজেট ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাঁরা আরও বলেন, রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় কাঠামোগত দুর্বলতা, করজালের সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্বল সমন্বয়ের কারণে রাজস্ব সংগ্রহে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে না।
অর্থনীতিবিদদের সতর্কতা
জুন মাসের এই চাপ নিয়ে অর্থনীতিবিদরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, সরকার যদি এই ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ ঋণ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকায় নির্ভর করে, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে, যা সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মোইনুল হাসান বলেন, “রাজস্ব ঘাটতি পূরণে জোর করে আদায়ের চেয়ে রাজস্ব নীতিতে সংস্কার ও কর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনাই হবে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর সমাধান।”
সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
দেশের রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা যে একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, জুন মাসের এই অভূতপূর্ব লক্ষ্যমাত্রা সেটাই স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত এনবিআর আধুনিক, তথ্যভিত্তিক ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, ততদিন এই ঘাটতি যেন নৈমিত্তিক সমস্যাতেই পরিণত হতে চলেছে।
এই অবস্থায় জুন মাসের রাজস্ব আদায়ের গতি কেমন হয়, তা শুধু বর্তমান অর্থবছরের হিসাব নয়, বরং আগামী বাজেট বাস্তবায়নের জন্যও নির্ধারক হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ