
ছবি: সংগৃহীত
একজন হলিউড তারকার জীবনের আড়ালে কতটা অন্ধকার জমে থাকে, তা অনেক সময় দর্শকের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। ঝলমলে আলো, ক্যামেরা, কোটি টাকার সম্পদ আর বিশ্বজোড়া খ্যাতির মাঝেও কেউ কখনো গভীর একাকিত্ব ও মানসিক অস্থিরতার শিকার হতে পারেন—সেই বাস্তবতার নির্মম প্রমাণ হলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
বর্তমানে তিনি শুধু বিশ্বসুন্দরী কিংবা সফল অভিনেত্রীই নন, একজন মানবিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও পরিচিত। জাতিসংঘের বিশেষ দূত থেকে শুরু করে ছয় সন্তানের মা—প্রতিটি ভূমিকাতেই তিনি অনন্য। কিন্তু আজকের এই আত্মবিশ্বাসী, পরিপূর্ণ নারীর পেছনে এক ভয়ঙ্কর কাহিনি লুকিয়ে ছিল, যেটি অনেকেরই অজানা।
প্রায় দুই দশক আগে, বয়স তখন মাত্র ২০। তখনও সবে সবে বলিষ্ঠ ক্যারিয়ারের শুরু। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তখন জর্জরিত ছিলেন চরম হতাশা, বিষণ্নতা আর মানসিক ভাঙনের ভেতর দিয়ে। নিজের অস্তিত্বই যেন তখন জোলির কাছে এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরাসরি আত্মহত্যা করলে তার পরিবার কষ্ট পাবে—এই ভাবনা তাকে অন্য এক পথ দেখায়।
সে সময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজেকে শেষ করতে ভাড়া করবেন একজন পেশাদার খুনি! হ্যাঁ, বাস্তবেই যোগাযোগ করেছিলেন এমন একজনের সঙ্গে, যিনি অর্থের বিনিময়ে মানুষের জীবন নিয়ে থাকেন।
তবে সেই খুনিই, যিনি পেশায় জীবনসংহারক, জোলিকে থামিয়ে দেন। তিনি তাকে বলেন, “নিজের জীবন নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখো। এরপর দু’মাস পর যদি সিদ্ধান্ত না বদলাও, তাহলে আবার দেখা হবে।”
সেই কথাটিই ছিল জীবনের মোড় ঘোরানোর জন্য এক ঝাঁকুনির মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জোলি বুঝে ফেলেন—এই জীবনে এখনও অনেক কিছু বাকি আছে, অনেক কিছু দেওয়ার আছে।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। উঠে দাঁড়িয়েছেন নতুনভাবে। সেই মৃত্যুর ইচ্ছা নিয়ে বসে থাকা তরুণীই হয়ে উঠেছেন জীবনের অন্যতম বড় উদাহরণ, একজন নির্ভীক, মানবিক, শক্তিমান নারী।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই অভিনয়ের জগতে হাতেখড়ি অ্যাঞ্জেলিনা জোলির। ১৯৮২ সালে বাবার সঙ্গে ‘Looking to Get Out’ ছবিতে প্রথম অভিনয়। এরপর ১৯৯৯ সালে 'Girl, Interrupted' ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য জিতে নেন অস্কার—সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘Lara Croft: Tomb Raider’, ‘Mr. & Mrs. Smith’, ‘Wanted’, ‘Salt’, ‘Maleficent’সহ একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করে হলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেত্রীদের তালিকায় চলে আসেন। শুধুমাত্র ‘Maleficent’ থেকেই আয় করেন ৩৩ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮২ কোটি টাকা।
অভিনয়ের বাইরেও জোলি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একজন সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা হিসেবে। তিনি Saint John ব্র্যান্ডের সঙ্গে করেছেন ১২ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি। এছাড়া গঠন করেছেন নিজের ফ্যাশন লাইন—‘Atelier Jolie’, যার মাধ্যমে গৃহহীনদের সৃজনশীলতায় যুক্ত করতে চান। পোশাকশিল্পের মাধ্যমে সমাজসেবার এক নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন এই উদ্যোগে।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ব্যক্তিগত জীবনও এক সময় ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম বিয়ে করেন অভিনেতা জনি লি মিলারকে। বিয়ের দিন নিজের রক্ত দিয়ে স্বামীর নাম লিখেছিলেন তার পোশাকে—এ ঘটনাই সে সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোড়ন তোলে। তবে সে সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, ভেঙে যায় ১৯৯৯ সালে।
পরবর্তীতে ২০০০ সালে বিয়ে করেন অভিনেতা বিলি বব থর্নটনকে। সেই সম্পর্কেরও পরিসমাপ্তি ঘটে ২০০৩ সালে।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত সম্পর্ক ছিল অভিনেতা ব্র্যাড পিটের সঙ্গে। একসঙ্গে ‘Mr. & Mrs. Smith’ ছবিতে কাজ করার সময় ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, যা পরিণত হয় সম্পর্কে। ২০১৪ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দম্পতি হিসেবে তিনটি শিশু দত্তক নেন—ম্যাডক্স, প্যাক্স ও জাহারা। পরবর্তীতে নিজেরা আরও তিন সন্তান জন্ম দেন—শিলোহ, নক্স ও ভিভিয়েন। তবে ২০১৬ সালে সেই সম্পর্কও ভেঙে যায়।
বর্তমানে ছয় সন্তানের মা জোলি। বহুবার বলেছেন, মা হওয়াটাই তাকে জীবনের সবচেয়ে বেশি শান্তি ও অর্থ দিয়েছে। সন্তানদের মানুষ করার মাঝেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে।
তবে শুধু মা নয়, জোলি এখন একজন আন্তর্জাতিক মানবিক ব্যক্তিত্ব। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করেছেন আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে। শরণার্থীদের জন্য কল্যাণমূলক উদ্যোগ এবং নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলে বিশ্বজুড়ে সম্মান পেয়েছেন।
একজন মানুষ যখন জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও হাল না ছেড়ে সামনে এগিয়ে যান, তখনই তিনি হয়ে ওঠেন এক অনুপ্রেরণার নাম। অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জীবনও ঠিক তেমনই—নিজেকে শেষ করতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসে আজ তিনি বিশ্বজুড়ে মানবতার মুখপাত্র, একজন মা, এক সংগ্রামী অভিনেত্রী এবং বহু নারীর রোল মডেল।
অতীতের সেই আত্মঘাতী চিন্তার গভীরতা থেকে উঠে আসা অ্যাঞ্জেলিনা এখন জীবনের জয়গান গাইছেন। তার জীবন কেবল একটি সফল ক্যারিয়ারের গল্প নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, পুনর্জন্ম, ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল ইতিহাস।
সূত্র: ডেইলি মেইল
বাংলাবার্তা/এমএইচ