
ছবি: সংগৃহীত
ঈদের আনন্দে যখন গোটা মুসলিম বিশ্ব মশগুল, তখন মৃত্যু আর ধ্বংসের মিছিল চলছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়। ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান হামলায় রোববার (৮ জুন) মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০৮ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩৯৩ জন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সন্ধ্যায় এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এই তথ্য জানায়। মন্ত্রণালয় জানায়, ঈদের দিনেও ইসরাইলের যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং কামান থেকে বর্ষিত গোলায় গাজার বিভিন্ন এলাকায় চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে শুরু হওয়া এই হামলা বিশেষভাবে দক্ষিণ গাজার রাফা, খান ইউনিস এবং মধ্য গাজার নুসাইরাত ও দেইর আল বালাহ এলাকায় বেশি তীব্র ছিল। বহু পরিবারের ওপর বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়, যেখানে ঈদ উদযাপন করতে জড়ো হয়েছিল বহু মানুষ।
একটি পরিবারের পুরো ১১ জন সদস্য নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় উদ্ধারকর্মীরা নিশ্চিত করেছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকের আটকে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অক্টোবর থেকে গাজায় মৃত্যুর পাহাড়
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক অভিযানের পর থেকেই গাজায় ব্যাপক অভিযান শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। সেই থেকে এ পর্যন্ত—গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী—মোট নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৮৮০ জনে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ জন।
এই হতাহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু এবং নারী। জাতিসংঘের মতে, ৫০ শতাংশের বেশি নিহত শিশু। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষ গৃহহীন হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন।
২০২৪ সালের মার্চে যুদ্ধবিরতির আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর আবারও সহিংসতা শুরু হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন আরও ৪,৬০৩ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন ১৪,১৮৬ জন।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আর গ্রেফতারি পরোয়নাও থামাতে পারেনি নেতানিয়াহুকে
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক সমালোচনা কিংবা আইনি বাধার তোয়াক্কা না করেই আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছরের নভেম্বরেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
এর পরও নেতানিয়াহু নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তিনি বারবার বলে আসছেন, গাজার অভিযান যতদিন না হামাস সম্পূর্ণভাবে দুর্বল ও নিঃশেষ করা যাচ্ছে, ততদিন এই অভিযান চলবে। সেই সঙ্গে জিম্মিদের মুক্ত করাও তাঁর সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য বলে দাবি করেন তিনি।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অভিযানের আড়ালে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ধ্বংস করে দীর্ঘমেয়াদে ভৌগোলিক পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনা থাকতে পারে।
মার্কিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব, দ্বিধায় হামাস
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতির একটি খসড়া চুক্তি পেশ করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই এর ঘোষণা দেন এবং বলেন, এই প্রস্তাবনায় ইসরাইল সম্মতি দিয়েছে।
প্রস্তাবনার শর্ত অনুযায়ী প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশ, জিম্মি ও বন্দি বিনিময় এবং দ্বিতীয় ধাপে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে।
তবে এই প্রস্তাবনাকে এখনো অনুমোদন দেয়নি হামাস। দলটি বলছে, ইসরাইলের প্রকৃত অভিপ্রায় পরিষ্কার নয় এবং নেতানিয়াহুর যুদ্ধ অব্যাহত রাখার বক্তব্য এই প্রস্তাবের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ করছে।
মানবিক বিপর্যয় চরমে
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গাজায় চলমান পরিস্থিতিকে ‘নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও ডব্লিউএফপি বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে যেন যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সহায়তা ঢোকানোর সুযোগ দেওয়া হয়।
তবে ইসরাইল সীমিতসংখ্যক রিলিফ কনভয় প্রবেশের অনুমতি দিলেও সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। ফলে গাজা উপত্যকায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখন অনাহার, তৃষ্ণা ও রোগব্যাধিতে ধুঁকছেন।
ঈদের দিন গাজার শিশুদের কান্না
একসময় ঈদ মানেই ছিল গাজায় শিশুদের মুখে হাসি, নতুন জামা, খেলার সামগ্রী। কিন্তু ২০২৪ সালের এই ঈদ যেন এক মৃত্যু-উৎসবে পরিণত হয়েছে। এক শিশুর ভাষায়, “আমি ঈদে বাবাকে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আর ফিরবেন না।”
এই কষ্টই যেন ফিলিস্তিনের প্রতিটি পরিবারে আজ এক অভিন্ন বাস্তবতা। ঈদের নামাজ পড়ার মতো জায়গা নেই, নেই নিরাপদ আশ্রয়, নেই খাবার, নেই শান্তি।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “এই ঈদ যেন আরেকটি শোকবিধুর দিন হয়ে উঠেছে গাজার মানুষের জন্য। মানবতা আজ চরম পরীক্ষা দিচ্ছে।”
বিশ্বের বহু শহরে ঈদের দিন গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। লন্ডন, ইস্তাম্বুল, নিউ ইয়র্ক, জাকার্তা, কায়রো, ইসলামাবাদ, ঢাকা—প্রতিটি শহরেই মানুষের কণ্ঠে ছিল একই স্লোগান: “গাজায় গণহত্যা বন্ধ করো”।
তবে কূটনৈতিক আলোচনা ও আন্তর্জাতিক নিন্দার মধ্যেও ইসরাইলি বোমা গাজার আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে অবিরাম। গাজার আকাশে আতশবাজি নয়, ঈদের দিনও ছিল কেবল আগুন আর ধোঁয়ার গন্ধ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ