
ছবি: সংগৃহীত
সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব.) মোহাম্মদ রাশেদ খান সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই প্রধান অভিযুক্ত—সাবেক টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ লিয়াকত আলীর দণ্ডাদেশ বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আরও ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও প্রত্যেকের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডের আদেশও বহাল রাখা হয়েছে।
২০২৫ সালের ২ জুন (সোমবার) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের উভয়পক্ষের দীর্ঘ শুনানি ও যুক্তিতর্ক শেষে গত ৩০ মে রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত। এরপর আজ উচ্চ আদালত আলোচিত এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করলেন।
মামলার পটভূমি
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর তিনি ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি নির্মাণে কাজ করছিলেন। ঘটনার সময় তার সঙ্গে ছিলেন সঙ্গী ও ইউটিউবার সিফাত এবং স্টাফ শিপ্রা। হত্যাকাণ্ডটি দেশব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভ ও আলোচনার জন্ম দেয় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
ঘটনার পরপরই নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে র্যাব তদন্ত করে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়, যেখানে প্রদীপ, লিয়াকতসহ মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
বিচারিক আদালতের রায়
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। তাতে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অপর ছয়জন—পুলিশ সদস্য নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা এবং টেকনাফের বাসিন্দা ও পুলিশের মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, মো. নেজামউদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এ ছাড়া সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়।
বিচারিক রায় অনুযায়ী, প্রত্যেক দণ্ডিত আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়, যা আদালতের হেফাজতে ছিল। নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের রায় অনুমোদনের জন্য ‘ডেথ রেফারেন্স’ হিসেবে হাইকোর্টে পাঠানো হয় এবং একই সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন।
হাইকোর্টের রায় এবং শুনানি
হাইকোর্টে রায়ের সময় রাষ্ট্রপক্ষে নেতৃত্ব দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. গিয়াসউদ্দিন গাজি, লাবনি আক্তার, তানভীর প্রধান, সুমাইয়া বিনতে আজিজ ও আসাদুল্লাহ আল গালিব। তারা যুক্তিতর্কে জানান, নিম্ন আদালতের রায় যথাযথ এবং ন্যায়বিচার সম্মত। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে তারা দাবি করেন এবং নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা বহাল রাখার আবেদন করেন।
হাইকোর্ট বেঞ্চ সবদিক বিবেচনায় নিয়ে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই করে রায়ে জানান, মেজর সিনহা হত্যার ঘটনা ছিল "পরিকল্পিত, নির্মম এবং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায় এড়ানো সম্ভব নয়।" আদালত বলেন, “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এমন হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস না পায়।”
এক্স-ফোর্সেস ও সিনহার পরিবারের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর ‘এক্স-ফোর্সেস’ নামক সাবেক সেনাসদস্যদের সংগঠন দ্রুততম সময়ে দণ্ড কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, “এই রায় জাতিকে আশ্বস্ত করেছে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তবে দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রেও যেন আর কোনো দেরি না হয়।” এ ছাড়া রায় ঘোষণার আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে সিনহার পরিবারের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তারা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ন্যায়বিচার প্রত্যাশার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সাজাপ্রাপ্তদের তালিকা
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত:
প্রদীপ কুমার দাশ (সাবেক ওসি, টেকনাফ থানা)
মো. লিয়াকত আলী (সাবেক পরিদর্শক, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র)
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত:
নন্দ দুলাল রক্ষিত (উপ-পরিদর্শক, বরখাস্ত)
সাগর দেব (পুলিশ সদস্য, বরখাস্ত)
রুবেল শর্মা (পুলিশ সদস্য, বরখাস্ত)
নুরুল আমিন (স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের সাক্ষী)
মো. নেজামউদ্দিন (স্থানীয় বাসিন্দা)
বাংলাবার্তা/এমএইচ