
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত ‘জুলাই গণহত্যা’র বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। রোববার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই গণহত্যা-সংক্রান্ত মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (চার্জ) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন টিম। এতে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এই মামলায় আরও অভিযুক্ত হয়েছেন তার সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
রবিবার বেলা ১২টার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এই ঐতিহাসিক শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করা হয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি)। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তা লাইভ সম্প্রচারে নজিরবিহীন আগ্রহ ও সাড়া দেখা যায়।
তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমের ভাষ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে দেশব্যাপী সংঘটিত যে ধারাবাহিক গণহত্যা, গুম, নির্যাতন ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটে, সেটি ছিল একটি পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই কর্মকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে প্রমাণ পাওয়া গেছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা চার্জশিটে বলা হয়, এই হত্যাযজ্ঞে নিহত হয়েছেন প্রায় ৪ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী এবং সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা শেখ হাসিনার আদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে গণগ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের ঘটনা পরিচালনা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি নির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে—মানবতাবিরোধী হত্যা, গুম, অপহরণ, নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ দাখিলের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসেবে দেখছি। দেশের মানুষ সত্য জানতে চায়। যারা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের বিচার আমরা করব—এটি আমাদের অঙ্গীকার।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই, এই বিচার এমনভাবে সম্পন্ন হোক যাতে কেউ পরবর্তীতে প্রশ্ন তুলতে না পারে। সঠিক প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক মান এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারকাজ চলবে। ডিসেম্বরের মধ্যেই জনগণ এই মামলায় দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাবে।”
শেখ হাসিনাকে ‘গুমের রাজনীতি এবং আয়নাঘর অপারেশনের নিউক্লিয়াস’ বলে উল্লেখ করে প্রসিকিউটর আরও বলেন, “এ মামলার তদন্ত এখনও চলমান। তবে যেসব প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি, তাতে স্পষ্টভাবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের পেছনে অন্যতম নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। আমাদের কাজ বিচার নিশ্চিত করা, প্রতিশোধ নয়। আমরা আইনের ভিত্তিতে কাজ করব।”
২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে শুরু হয়ে আগস্টজুড়ে দেশজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড়, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুলি চালনার ঘটনায় অন্তত ৪ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে এসব হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায় এবং আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি তোলে।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজ, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সাক্ষ্য, বিভিন্ন হাসপাতালে সংরক্ষিত মরদেহের রেকর্ড এবং মেডিকেল রিপোর্টের মাধ্যমে এসব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় বলে জানায় তদন্ত সংস্থা।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, “শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা প্রথম অভিযোগ হলো, তিনি সরাসরি এই গণহত্যার পরিকল্পক, নির্দেশদাতা এবং প্রধান রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিশ্চিহ্ন করতে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের অপরাধ কখনো সাধারণ ফৌজদারি আইনে বিচার সম্ভব নয়। এজন্যই আন্তর্জাতিক মানে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের মানদণ্ড অনুসরণ করেই এই মামলার বিচারকাজ এগিয়ে নিচ্ছি।”
এই মামলার অভিযোগ দাখিলের পর দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল এ ঘটনাকে ‘দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত ন্যায়বিচারের সূচনা’ বলে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। প্রথমবারের মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিলেন, তাকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলো।
বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। তবে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আশা প্রকাশ করেছেন, “এই মামলার অগ্রগতি ডিসেম্বরের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে। এমনকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক শুনানি এবং সাক্ষ্যগ্রহণও শুরু হতে পারে।”
বিশ্ব রাজনীতির চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারের বিরুদ্ধে এমন মামলা ও বিচার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও—এমনটাই বলছেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ