
ছবি: সংগৃহীত
গত কয়েক দশকে বলিউডের চলচ্চিত্রশিল্প শুধু ভারতেই নয়, বরং গোটা বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছে। এক সময় বলিউড সিনেমার দর্শকসংখ্যা মূলত উপমহাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে এর ভৌগোলিক সীমা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। উন্নত প্রযোজনা মান, নানাবিধ ভাষার ডাবিং, বিশ্বব্যাপী বিপণন কৌশল এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সহজলভ্যতার ফলে আজকের বলিউড সিনেমা যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা থেকে শুরু করে দূরপ্রাচ্যের দেশ চীনেও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আর এই প্রসারে অন্যতম বড় অবদান রেখেছেন বলিউডের তারকা অভিনেতারা, যারা নিজেদের অভিনয় দক্ষতা এবং জনপ্রিয়তার জোরে সিনেমাকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন। এই তালিকায় সবচেয়ে অগ্রগণ্য নাম নিঃসন্দেহে আমির খান।
সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম একটি বিস্তৃত তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে বলিউডের যেসব সিনেমা বিশ্বজুড়ে ২০০ কোটির বেশি ভারতীয় রুপি আয় করেছে, তাদের পরিসংখ্যান। সেই তালিকায় ‘থ্রি ইডিয়টস’ থেকে শুরু করে ‘ডাঙ্কি’ ও ‘জওয়ান’-এর মতো সাম্প্রতিক হিট সিনেমা পর্যন্ত রয়েছে। তবে সব সিনেমাকে ছাড়িয়ে, একমাত্র যিনি এখনো পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছেন—তিনি আমির খান। তার অভিনীত ও ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘দঙ্গল’ এখনও পর্যন্ত বলিউড ইতিহাসে বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ আয়কারী সিনেমা হিসেবে শীর্ষস্থানে রয়েছে। এই সিনেমা মোট আয় করেছে প্রায় ২০৫৯ কোটি ভারতীয় রুপি, যার বড় অংশ এসেছে চীনের বিশাল বক্সঅফিস থেকে।
‘দঙ্গল’ মূলত ভারতের কুস্তিগির গীতা ও ববিতা ফোগাটের জীবনকাহিনী অবলম্বনে নির্মিত একটি বায়োপিক, যেখানে আমির খান কুস্তিগির ও পিতা মহাবীর সিং ফোগাটের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমা মুক্তির পর প্রথম পর্যায়ে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭৫০ কোটি রুপি আয় করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে চীনে মুক্তি পাওয়ার পর, সিনেমাটি সেখানকার বক্সঅফিসে দারুণ সফলতা পায় এবং অতীতের সকল বলিউড রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে, তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’, যা বিশ্বব্যাপী আয় করেছে ১১৬৩ কোটি রুপি। একশনধর্মী এই সিনেমা দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় পরিচালক অ্যাটলি নির্মাণ করেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণী সুপারস্টার আল্লু অর্জুন অভিনীত ‘পুষ্পা-২ (হিন্দি ভার্সন)’, যার আয় ১০৮৬ কোটি রুপি। এটি দেখিয়ে দেয়, বলিউডে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার প্রভাবও কতটা বাড়ছে।
তালিকার চতুর্থ স্থানে শাহরুখেরই আরেক হিট ছবি ‘পাঠান’, যার আয় ১০৬৯ কোটি রুপি। পঞ্চম স্থানে রয়েছে সালমান খানের মানবিক চরিত্রে অভিনীত ‘বজরঙ্গী ভাইজান’, যেটি আয় করেছে ৯১৫ কোটি রুপি।
এই তালিকায় আরও আছে রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমেল’ (৯১০ কোটি), আমির খানেরই ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ (৯০২ কোটি), প্রভাসের ‘বাহুবলী-২ (হিন্দি ভার্সন)’ (৮৯৩ কোটি), রাজকুমার রাওয়ের ‘স্ত্রী-২’ (৮৮৪ কোটি), এবং আমির খানেরই আরেক ক্লাসিক ‘পিকে’ (৮৩১ কোটি)।
এই তালিকাটি থেকে আরও একটি বড় উপলব্ধি পাওয়া যায় যে, শুধু বড় তারকা নয়, বরং কনটেন্ট এবং স্টোরিলাইনের বৈচিত্র্যই মূলত দর্শকদের টেনে আনছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ ছিল এক কিশোরীর গায়কী প্রতিভার গল্প, যা চীনে বিশাল সফলতা পেয়েছে। আবার, ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ বা ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ জাতীয়তাবাদ-ঘেঁষা বিষয়বস্তুর কারণে দেশীয় দর্শকদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া, তালিকায় শামিল আছে ‘ধুম-৩’ (৬০১ কোটি), ‘সুলতান’ (৫৮৯ কোটি), ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার-২ (হিন্দি)’ (৫৮৩ কোটি), ‘পদ্মাবত’ (৫৬০ কোটি), ‘সঞ্জু’ (৫৪১ কোটি), ‘টাইগার-৩’ (৪৭২ কোটি), এবং ‘ডাঙ্কি’ (৪৭০ কোটি) প্রভৃতি ব্লকবাস্টার সিনেমা।
শাহরুখ খান, সালমান খান, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, হৃত্বিক রোশন থেকে শুরু করে রণবীর কাপুর, রণবীর সিং, কার্তিক আরিয়ান পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজন্মের তারকার সিনেমাগুলোর অবস্থান রয়েছে এই তালিকায়। বলা যায়, প্রতিটি দশকেই বলিউডে তারকা শক্তির পাশাপাশি স্ক্রিপ্ট এবং নির্মাণে মৌলিকতার কারণে দর্শকদের আকর্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
তালিকার নিচের দিকে যেসব সিনেমা রয়েছে সেগুলোও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন—‘থ্রি ইডিয়টস’ (৩৯৫ কোটি), ‘কিক’ (৩৭৭ কোটি), ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ (৩৮৫ কোটি), ‘কৃষ-৩’ (৩৭৪ কোটি), ‘কবির সিং’ (৩৬৮ কোটি), ‘তানহাজি’ (৩৬৪ কোটি), ‘আরআরআর (হিন্দি)’ (৩৪২ কোটি), ‘উরি’ (৩৩৫ কোটি), ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ (৩২৬ কোটি), ‘এক থা টাইগার’ (৩২০ কোটি), ‘রইস’ (২৮৭ কোটি), এবং ‘মিশন মঙ্গল’ (২৮৭ কোটি)।
সবশেষে, এই তালিকা থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে বলিউড এখন আর শুধু ভারতীয় সিনেমা নয়—এটি একটি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক পণ্য। আর এই বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণে আমির খান তার অভিনয় দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য গল্প নির্বাচন করার দূরদর্শিতার মাধ্যমে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। ‘দঙ্গল’ এবং ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে কনটেন্টই রাজা, এবং একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প সর্বত্র গ্রহণযোগ্যতা পায়—সীমান্ত ও ভাষা পেরিয়ে।
বিশ্বব্যাপী বলিউডের এই বিস্তৃত ও বর্ণাঢ্য যাত্রা যে ভবিষ্যতে আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর সেই উচ্চতায় কে উঠবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বর্তমানের চিত্রে—‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ আমির খানই রয়েছেন সবার উপরে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ