
ছবি: সংগৃহীত
গাজার আকাশে এখনও ভোরের আলো ফোটেনি। শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদছে, মায়েরা নিঃশব্দে মাথায় কাপড় জড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে। বাবা কিংবা বড় ভাইয়েরা তখন প্রস্তুত হচ্ছেন বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য—গন্তব্য, গাজার দক্ষিণাঞ্চলে স্থাপিত মানবিক সহায়তা কেন্দ্র। উদ্দেশ্য একটাই—সন্তানদের মুখে একটুকরো রুটি তুলে দেওয়া। কিন্তু এই নিঃস্ব মানুষেরা রুটির বদলে বাড়ি ফিরছেন মাথায় গুলি নিয়ে। কেউ ফিরছেন স্ট্রেচারে, কেউ আর ফিরছেনই না—লাশ হয়ে পড়ে থাকছেন হাসপাতালের মর্গে।
এটাই এখন গাজার বাস্তবতা। রুটির আশায় যারা বের হন, তারা গুলির শিকার হয়ে হাসপাতালের বেডে কিংবা কবরের মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েন। সম্প্রতি ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে রাফা ও খান ইউনিসে এমন শত শত ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন বহু নিরপরাধ মানুষ। সহিংসতা ও খাদ্যসংকটে বিপর্যস্ত গাজার এই করুণ চিত্র বিশ্ববাসীকে হতবাক করছে, কিন্তু ইসরাইলি আগ্রাসনের লাগাম টেনে ধরার জন্য কেউ কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
রুটির বদলে গুলি: এক করুণ ভোর
রোববারের ভোরে গাজার দক্ষিণাঞ্চল রাফার আল-আলম গোলচত্বরে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সকাল ৬টার দিকে, ঠিক যখন মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল, হঠাৎই চারদিক থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। গুলির আওয়াজে আতঙ্কে মানুষ ছুটতে শুরু করে, কিন্তু অনেকেই আর বাঁচতে পারেননি।
রেড ক্রসের তথ্যমতে, আহত হয়েছেন অন্তত ১৭৯ জন, যাদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। নিহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন। তবে হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স সংস্থার মতে, নিহতের সংখ্যা ৩১ জন ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছেন।
শুয়াইব আবু তইরের গল্প
এই হামলার শিকারদের একজন ছিলেন শুয়াইব আবু তইর। চার সন্তানের জনক এই মানুষটি খাবার আনতে গিয়েছিলেন রোববার সকালে। কিন্তু বাড়ি ফিরেছেন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে। এখন তিনি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
তার শ্যালিকা আসমা আবু সালাহ কান্না চেপে বললেন, “সে তো শুধু বাচ্চাদের খাবার আর পানির জন্য গিয়েছিল। ওর ছেলেমেয়েরা বলেছে—‘বাবা, আমাদের খাবার দাও’। এই কথাটাই সবচেয়ে কষ্টের। সে তো শুধু রুটি আনতে গিয়েছিল, ওরা তার মাথায় গুলি চালিয়েছে।”
গণহত্যার অভিযোগ
গাজার ফিল্ড হাসপাতালের পরিচালক মারওয়ান আল-হেমস বলেছেন, “রোববার যা ঘটেছে তা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা ছিল একটি সুপরিকল্পিত গণহত্যা।” তিনি আরও জানান, আহতদের বেশিরভাগের শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন রয়েছে। অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
রেড ক্রস বলছে, রাফার ফিল্ড হাসপাতালে ১৭৯ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের অনেকেই জানান যে তারা রুটির আশায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। অধিকাংশের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
হামলা অব্যাহত: নতুন করে নিহত আরও ৩
রোববারের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সোমবারও হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। এদিন রাফায় আরও একটি সহায়তা কেন্দ্রের লাইনে থাকা মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এতে নিহত হন আরও তিনজন এবং আহত হন অন্তত ৩৫ জন। এছাড়া গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ও বুধবারও এমন হামলার ঘটনা ঘটে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিন শরণার্থী সংস্থা (UNRWA) বলেছে, “সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এখন রুটির বদলে মৃত্যু বিলিয়ে দিচ্ছে। এটি যেন এক নিঃশব্দ হত্যাযজ্ঞের নতুন রূপ।” সংস্থাটি এই হামলাগুলোর স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
হাসপাতালেও রেহাই নেই
ইসরাইলি বর্বরতা শুধু ত্রাণ লাইনে সীমাবদ্ধ নেই। সোমবার আলজাজিরা জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ার একমাত্র কিডনি ডায়ালাইসিস কেন্দ্র ‘নূরা আল-কাবি’। এই কেন্দ্রটি প্রতি সপ্তাহে প্রায় শতাধিক রোগীকে সেবা দিতো। এখন সেই রোগীরা চিকিৎসাবিহীন মৃত্যু ঝুঁকিতে।
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া ও ইসরাইলের অস্বীকার
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোববারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “গাজায় সাহায্য চাইতে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। আমি স্বাধীন ও দ্রুত তদন্ত চাই এবং দায়ীদের জবাবদিহি করার আহ্বান জানাই।”
কিন্তু ইসরাইলি সেনাবাহিনী বরাবরের মতোই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, ত্রাণকেন্দ্রের কাছে কিংবা এর ভেতরে কোনো গুলি চালানো হয়নি। বরং তারা হামাসের বিরুদ্ধে ‘গুজব ছড়ানো’র অভিযোগ এনেছে।
ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যকে ‘অপমানজনক’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, “তিনি হামাসের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি, যা নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ।”
ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান: ৮ মাসে মৃত্যু ৫৪ হাজার ছাড়াল
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল-গাজা সংঘর্ষে সোমবার (২ জুন) পর্যন্ত ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৪৭০ জন। আহত হয়েছেন এক লাখ ২৪ হাজার ৬৯৩ জন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায়ই প্রাণ হারিয়েছেন ৫২ জন।
এই ভয়াবহ পরিসংখ্যানের পেছনে প্রতিদিনের এমন অসংখ্য হত্যাকাণ্ড লুকিয়ে আছে, যার বেশির ভাগই ঘটছে শিশু, নারী ও বেসামরিক পুরুষদের বিরুদ্ধে। খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যারা প্রাণ হারাচ্ছেন, তাদের কোনো অপরাধ নেই—তাদের দোষ একটাই, তারা ফিলিস্তিনি।
বিশ্ব নীরব, গাজা পুড়ছে
গাজা যেন এখন এক উন্মুক্ত কবরস্থান। প্রতিদিন সেখানে নতুন করে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। অথচ বিশ্ব নেতৃত্ব এখনো কার্যকরভাবে এগিয়ে আসছে না। জাতিসংঘ আহ্বান জানালেও এর বাস্তব প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই নির্লিপ্ততা মানবাধিকারের চরম পরিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজায় এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোও পড়ে। যে মানুষগুলো রুটি সংগ্রহ করতে যায়, তারা জানে না তারা জীবিত ফিরে আসবে কি না। গাজায় এখন রুটির দাম মৃত্যু। আর সেই মূল্য গুনছে প্রতিদিন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ