
ছবি: সংগৃহীত
দেশে গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না—তাদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার যাতে বিচার পায়, সেই নিশ্চয়তা দিতেই সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। ৪ জুন বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির মিলনায়তনে আয়োজিত এক সরকারি ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন শফিকুল আলম।
ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গুম ইস্যুকে জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সংকট হিসেবে দেখছেন। তিনি ৩ শতাধিক নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং স্পষ্টভাবে বলেছেন, যারা গুমের সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতেই হবে। বিচার হবে এ দেশের আদালতেই।”
গুমের বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে প্রেস সচিব আরও বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা জানতে চেয়েছেন, নিখোঁজদের খুঁজে বের করতে ও বিচার নিশ্চিত করতে জরুরি করণীয় কী কী। এটি শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনের ইস্যু নয়, এটি মানবিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।”
প্রেস সচিব শফিকুল আলম গুমের সঙ্গে র্যাবের সম্পৃক্ততা নিয়ে গুম তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বলেন, “র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ছিল ভয়ংকর হত্যাযন্ত্র। তারা শুধু তথ্য সংগ্রহের কাজ করতো না—তারা সরাসরি অপহরণ, নির্যাতন ও গুমের মতো অপরাধে অংশ নিত। কমিশনের তথ্যমতে, র্যাব সদস্যরা পদোন্নতি, বাহবা এবং ভালো পোস্টিং পাওয়ার জন্যও গুমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তো।”
তিনি বলেন, “এই ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। বিচার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন অপরাধ করতে না পারে। প্রধান উপদেষ্টা এই অপরাধের সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটনের নির্দেশ দিয়েছেন।”
গুমের ভয়াবহতা এবং নির্যাতনের স্মৃতি জাতির সামনে স্থায়ীভাবে তুলে ধরতে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রেস সচিব জানান, “গণভবনের সংলগ্ন এলাকায় নির্মিত হবে ‘হরর মিউজিয়াম’। এটি শুধু একটি যাদুঘর নয়, এটি হবে রাষ্ট্র-সমর্থিত সন্ত্রাস ও গুমের ইতিহাসের দলিল।”
এই মিউজিয়ামে র্যাবসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে সংঘটিত গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো আলোকচিত্র, ভিডিও সাক্ষ্য ও নথির মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি থাকবে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সাক্ষাৎকার ও স্মারক।
প্রেস সচিব বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানে রাষ্ট্র কখনোই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। এই হরর মিউজিয়াম হবে আমাদের জাতীয় বিবেকের ঘুম ভাঙানোর স্থান।”
শফিকুল আলম জানান, “৫ জুন বৃহস্পতিবার থেকে গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু হবে। এই প্রতিবেদন হবে ধাপে ধাপে প্রকাশিত এবং এতে থাকবে নাম, স্থান, সময় ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিস্তারিত বিবরণ। এই কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশে কোনো রাখঢাক থাকবে না।”
গুম তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে একাধিক বাহিনীর নির্যাতনের প্যাটার্ন, অপারেশনের ধরন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনার ধরনও উঠে এসেছে। এই রিপোর্ট দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছেও পাঠানো হবে বলে প্রেস সচিব জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের ভেতরেই চাপ তৈরি হয়েছে। এটা কোনো বিদেশি চাপ নয়। জনগণের কাছে জবাবদিহির জন্যই সরকার এই পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করেছেন, এ বিষয়ে বিদেশি চাপ নয়—মানবিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
সরকারের এই অবস্থানকে অনেক বিশ্লেষক দেখছেন একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে। তাদের মতে, অতীতে গুমের অভিযোগগুলো যেভাবে অস্বীকার করা হতো, এখন সেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে বিচারের আশ্বাস দেওয়া রাজনৈতিক সদিচ্ছারই প্রমাণ।
এদিকে, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও সরকারিভাবে গুমের স্বীকৃতি এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। অনেকেই বলছেন, দীর্ঘদিন পর হলেও এখন অন্তত তারা আশা করতে পারছেন—প্রিয়জনের সন্ধান পাবেন, ন্যায়বিচার দেখতে পাবেন।
এখন সবার দৃষ্টি গুম কমিশনের রিপোর্ট এবং বিচারিক কার্যক্রমের দিকে। জাতি চায়, এই ন্যায়বিচার শুধু প্রতীকী না হয়ে হোক কার্যকর, দৃষ্টান্তমূলক—যাতে আর কোনো মা তার সন্তানকে খুঁজে না ফেরে, আর কোনো পরিবার নিখোঁজের যন্ত্রণা না ভোগ করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ