ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে গুম-খুনের মতো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানের আইনি পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ। আজ মঙ্গলবার (৩ জুন) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে হাজির হন এবং তার নিজ অভিজ্ঞতা ও দেশের চলমান গুম-খুনের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন।
এই অভিযোগ গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সালাহউদ্দিন আহমদ এ সময় ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের হাতে একটি লিখিত নথি তুলে দেন, যাতে তিনি শুধু নিজের নয়, বরং বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গুম, খুন, নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ ও ঘটনার উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন, এই অপরাধগুলোর পেছনে সরকারের শীর্ষ পর্যায়, বিশেষ করে শেখ হাসিনার প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, “আমি আজ চিফ প্রসিকিউটরের কাছে গুম ও খুনের অভিযোগ জমা দিয়েছি। এই অপরাধগুলো শুধু মানবিক নয়, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। এগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন হওয়ার যোগ্য। আমি চাই এই ট্রাইব্যুনালে গুম, খুন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মামলা দায়ের হোক।”
তিনি আরও বলেন, “বিগত ১৫ বছরে অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছেন। তাদের অনেকের হদিস নেই আজও। অথচ এখন পর্যন্ত খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অধিকাংশই রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমি চাই এই ট্রাইব্যুনাল শুধু বিচার নয়, গুমে জড়িতদের খুঁজে বের করুক। যারা গুমের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তাদের ব্যাপারে কমিশন যেন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে পদক্ষেপ নেয়।”
সালাহউদ্দিন আহমদ তার নিজের গুম হওয়ার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে। তিনি বলেন, “২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক ও পরিচয়ে সশস্ত্র একদল লোক আমাকে তুলে নেয়। এরপর দীর্ঘ ৬১ দিন আমাকে কোথায় রাখা হয়েছিল, কিভাবে রাখা হয়েছিল, কোন ধরনের পরিবেশে রাখা হয়েছিল, কারা দেখভাল করতো—সবিস্তারে তা আমি লিখিতভাবে জানিয়েছি।”
তিনি বলেন, “শেষপর্যন্ত আমাকে অন্য একটি দেশে পাচার করে দেওয়া হয়। এটা শুধু একজন রাজনীতিককে নিঃশেষ করার চেষ্টা নয়, এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একটা নমুনা। এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি, কোনো বিচার হয়নি। বরং আমি ফিরে আসার পর উল্টো আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা হয়েছিল।”
চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে দেওয়া বক্তব্যে সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করে বলেন, “আমি দাবি জানাচ্ছি, শেখ হাসিনাসহ গুম-খুনে জড়িত সবার বিচার করতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা যে দেশে বাস করছি, সেটি কোনো ব্যক্তির শাসন বা রুলবেইজ প্রশাসন নয়—একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।”
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “বাংলাদেশে গুমের সংস্কৃতি ভয়ঙ্কর মাত্রা নিয়েছে। এটা এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। শুধু বিএনপি নয়, বিভিন্ন মতাদর্শিক দলের নেতা-কর্মীরা, এমনকি সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, মানবাধিকার কর্মীরাও এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, রাষ্ট্র যদি চায়, তাহলে আজই গুম-খুন বন্ধ করা সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের অপরাধগুলোকে দীর্ঘদিন আড়ালে রাখা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ, জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের দায় রয়েছে এই অপরাধগুলো তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করার। সরকার যদি ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপও তখন যৌক্তিক হয়ে পড়ে।”
গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের নাম উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন বলেন, “সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হাসানসহ যারা গুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। শুধু নিম্নপর্যায়ের কয়েকজন সদস্যকে দোষারোপ করে পার পাওয়া যাবে না। যারা আদেশ দিয়েছেন, পরিকল্পনা করেছেন, রক্ষা করেছেন—তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।”
চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দিলেও সালাহউদ্দিন আহমদ খোলাখুলি জানান, এই ধরণের বহু অভিযোগ পূর্বে জমা দেওয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। “আমি দেখতে চাই এই অভিযোগটি গ্রহণ করার পর তদন্ত শুরু হয়, বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। নতুবা জনগণের মধ্যে হতাশা আরও বাড়বে,” বলেন তিনি।
তিনি সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আমরা যদি আজ মুখ না খুলি, কাল আর সুযোগ থাকবে না।”
সালাহউদ্দিন আহমদের এই অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া এক নতুন নজির হয়ে দাঁড়াল। এর আগে এই ট্রাইব্যুনাল কেবল ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গুম-খুনের মতো আধুনিককালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও সেখানে উপস্থাপন শুরু হওয়ায়, এটি একটি নতুন ধারা রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
এই পদক্ষেপ কি আদৌ বিচার প্রক্রিয়ায় রূপ নিতে পারবে, নাকি এটিও পূর্ববর্তী শত অভিযোগের মতো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে খারিজ হয়ে যাবে—তা সময়ই বলে দেবে। তবে সালাহউদ্দিন আহমদের মতো একজন জাতীয় নেতা সরাসরি গুম কমিশনে এসে অভিযোগ জানানো নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে: গুম-খুনের বিচার চেয়ে মানুষ এখন নিরব নয়, বরং লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



