
ছবি: সংগৃহীত
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘিরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছিল আশাবাদ, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে মূল্যস্ফীতির চাপে নুয়ে পড়া সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তবে বাস্তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং অর্থ উপদেষ্টা পদক্ষেপ নিয়েছেন পুরোনো পথে—আয়করের কাঠামোয় পরিবর্তন এনে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্তের ওপর।
ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে ঠিকই, তবে এটি কার্যকর হবে ২০২৬ সালের জুলাই থেকে। বর্তমান ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পুরোনো সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকাই প্রযোজ্য থাকবে। কিন্তু এ স্ল্যাবের ওপরে করহার বাড়িয়ে দেওয়ায় মধ্যবিত্তের করভার বেড়ে যাচ্ছে। নতুন কাঠামোয় পরবর্তী ৩ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ নয়, ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। অর্থাৎ করমুক্ত সীমা অতিক্রম করার পরপরই আয়করের হার দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন করদাতার বার্ষিক আয় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা হলে, এক-তৃতীয়াংশ করমুক্ত থাকায় করযোগ্য আয় দাঁড়ায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বিদ্যমান নিয়মে তার কর দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার টাকা। কিন্তু নতুন কর কাঠামো অনুযায়ী ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার পর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে, ফলে কর বেড়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ তাকে বাড়তি আড়াই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।
তবে নতুন করদাতাদের জন্য স্বস্তির খবরও আছে। যারা প্রথমবার রিটার্ন দিচ্ছেন, তারা আয় অনুসারে সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়কর দিতে পারবেন। এই সুবিধা কর ভীতি দূর করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কর ফাঁকি রোধে অতীতে বহু সরকারি সেবায় কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক ছিল। এবার সেই বাধ্যবাধকতার কিছুটা শিথিলতা এসেছে। ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, সমবায় সমিতি নিবন্ধন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি বেতন গ্রহণ, পাঁচ লাখ টাকার বেশি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের হিসাব খোলা, এমন ১২টি সেবায় শুধু টিআইএন নম্বর জমা দিলেই চলবে, রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক নয়। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন।
মধ্যবিত্তের নিত্যপ্রয়োজনীয় জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটের ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তন। স্থানীয় উৎপাদনে উৎসাহ দিলেও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের খরচ বাড়ানো হয়েছে।
রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশনার তৈরিতে দেওয়া ভ্যাট অব্যাহতি বাতিল হওয়ায় দেশীয় ফ্রিজ ও এসির দাম বাড়তে পারে। একইভাবে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনে ভ্যাট বাড়ানোয় দেশীয় মোবাইল ফোনও দামী হবে।
প্লাস্টিকের তৈরি বাসা-বাড়ির গৃহস্থালি সামগ্রী যেমন টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টয়লেট সামগ্রী, হাইজেনিক পণ্যের ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণ হারে বাড়তে পারে। শেভিং ব্লেড উৎপাদনে ভ্যাট ৫ থেকে ৭ শতাংশ করায় সেগুলোর দামও বাড়বে।
রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের সুনির্দিষ্ট কর বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। বিলেট, ইনগট ও গলানোর রাসায়নিকের শুল্কও বেড়েছে। এতে রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। এছাড়া মার্বেল-গ্রানাইট পাথরের শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করায় অভিজাত ফ্লোরিং সামগ্রীর দাম দ্বিগুণ হতে পারে।
বিদেশি খেলনার ওপর ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোয় শিশুদের খেলনার দাম বেড়ে যাবে। পাশাপাশি চকলেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য ৪ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১০ ডলার করা হয়েছে, ফলে চকলেটের দামও বাড়বে।
নারীদের ব্যবহৃত সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রীর যেমন লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন, ফেসওয়াশ, মেকআপ কিটের আমদানি মূল্যে দ্বিগুণ বাড়তি ভিত্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ফলে এইসব বিদেশি কসমেটিকসের দাম বাড়া প্রায় নিশ্চিত।
অর্থ উপদেষ্টা মধ্যবিত্তের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে বড়লোকদের জন্য বেশকিছু সুবিধা রেখেছেন। যেমন সম্পদ কর বা সারচার্জের কাঠামোতে পরিবর্তন এনে বিত্তশালীদের করভার কমানো হয়েছে। ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর থেকে পরিবেশ সারচার্জ পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে—যা উচ্চবিত্ত শ্রেণির জন্য বড় সুখবর।
প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৫-২৬ দেখে সহজেই বলা যায়, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সরকার যে পথ বেছে নিয়েছে, তা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। আয়করের কাঠামোতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন থাকলেও তা ভবিষ্যতের জন্য, বর্তমান চাপ বরং বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো, গৃহস্থালি ব্যয় ও নির্মাণ খরচে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। অথচ বিত্তশালীদের জন্য কর ছাড় ও সুবিধা অব্যাহত রেখেছেন অর্থ উপদেষ্টা—যা সামগ্রিকভাবে বাজেটকে বৈষম্যমূলক ও বিতর্কিত করে তুলেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ