
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের ব্যাংক শাখাগুলোতে নগদ টাকা উত্তোলনের চাপ চরমে পৌঁছেছে। ছুটির আগে শেষ কার্যদিবস হওয়ায় বুধবার (৪ জুন) সকাল থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করা গেছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা এবং এটিএম বুথ থাকা সত্ত্বেও নগদ অর্থ সংগ্রহে গ্রাহকদের সরাসরি ব্যাংক শাখায় উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। কেউ কোরবানির পশু কেনার জন্য টাকা তুলতে এসেছেন, কেউ আবার ঈদের উপহারের জন্য নতুন নোট সংগ্রহে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঈদের আগের শেষ কার্যদিবসে ব্যাংকিং লেনদেনের পরিমাণ স্বাভাবিক দিনের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নগদ উত্তোলনের হার গত কয়েকদিনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেও অতিরিক্ত চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
ঢাকার মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন ও সদরঘাট এলাকার ব্যাংক শাখাগুলোতে সকাল থেকেই গ্রাহকদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকারি ডাচ্-বাংলা, ইসলামী, ব্র্যাক ও ইবিএল ব্যাংকের সামনে নগদ উত্তোলন ও জমা দেয়ার জন্য অপেক্ষারত গ্রাহকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
মতিঝিল এলাকার সোনালী ব্যাংকের একটি শাখায় টাকা তুলতে আসা ব্যবসায়ী রাজিবুল ইসলাম বলেন, “গরু কিনতে গেলে তো বড় অঙ্কের টাকা লাগে। এটিএম-এ অত টাকা ওঠে না, তাই শাখায় আসতেই হলো।”
তিনি জানান, ঈদের সময় পশুর হাটে লেনদেনের ক্ষেত্রে এখনো নগদ অর্থই সবচেয়ে কার্যকর, ফলে গ্রাহকদের বাধ্য হয়েই ব্যাংকে আসতে হয়।
নগদ উত্তোলনের পাশাপাশি ব্যাংকে গ্রাহকদের ভিড় বাড়ার অন্যতম কারণ নতুন নোট সংগ্রহ। অনেকে ঈদ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, সন্তান কিংবা ছোটদের উপহার দেয়ার জন্য নতুন ডিজাইনের নোট সংগ্রহে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ঈদের আগে সীমিত পরিসরে ২০, ৫০ এবং এক হাজার টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়লেও, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশ গ্রাহক নতুন নোট না পেয়ে হতাশ হয়েছেন।
রূপালী ব্যাংকের করপোরেট শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “অনেকেই শুধু নতুন নোট সংগ্রহ করতে আসছেন। কিন্তু আমাদের কাছে সরবরাহ সীমিত, তাই চাহিদার পূরণ সম্ভব হচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, “বিশেষ করে গ্রাম বা মফস্বল অঞ্চলে ঈদের সময় নতুন নোটের চাহিদা তুলনামূলক বেশি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হুসেইন খান জানান, “এবার ঈদের আগে সীমিতভাবে ২০, ৫০ এবং এক হাজার টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়েছে। ঈদের পর নতুন নকশার পাঁচ, ১০, ১০০, ২০০ এবং ৫০০ টাকার নোট ছাপানোর কাজ শুরু হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহার সময় প্রচুর পরিমাণ নগদ অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে, বিশেষ করে পশুর হাটগুলোতে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এবার ডিজিটাল লেনদেন ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে। আরিফ হুসেইন খান বলেন, “আমরা পশুর হাটগুলোতে নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করছি এবং ডিজিটাল অর্থপ্রদানের সুযোগ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি।”
তবে বাস্তবতা হলো, দেশের অধিকাংশ হাটেই এখনো বিক্রেতারা নগদ টাকাই পছন্দ করেন। এক গরু ব্যবসায়ী জানান, “মোবাইল ব্যাংকিং বা কার্ডে লেনদেন করতে গেলে অনেক সময় ঝামেলা হয়। নগদেই সবকিছু সহজে করা যায়।”
ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হচ্ছে ৭ জুন থেকে, যা ১৪ জুন পর্যন্ত চলবে। তবে পোশাক শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ এবং রপ্তানি-আমদানির লেনদেন বজায় রাখার জন্য বিশেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আওতায় আগামী ৫ জুন (বৃহস্পতিবার), ১১ ও ১২ জুন (মঙ্গলবার ও বুধবার) শিল্পাঞ্চলগুলোর নির্দিষ্ট তফসিলি ব্যাংকের শাখাগুলো খোলা থাকবে। এর ফলে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, আশুলিয়া ও টঙ্গীর অনেক শ্রমিক ওই সময়ে বেতন তুলতে পারবেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের কোনো ঘাটতি নেই। তবে দুর্বল আর্থিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনার কারণে কিছু কিছু ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বড় উৎসবের সময় নগদ চাহিদা বাড়ে, ফলে ব্যাংকগুলোকেও বেশি পরিমাণ অর্থ মজুদ রাখতে হয়। কিন্তু যে সব ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল, তারা এ সময় গ্রাহক চাপ সামাল দিতে হিমশিম খায়।”
ঈদুল আজহাকে ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারও নগদ টাকার লেনদেনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ব্যাংক খাত। ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা যতই আধুনিক হোক না কেন, কোরবানির পশু কেনা, নতুন নোট সংগ্রহ কিংবা আত্মীয়দের উপহার দেয়ার মতো ব্যাপারে এখনো নগদ টাকার ব্যবহার সর্বাধিক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই সময় অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে যেমন দক্ষতার পরিচয় দিতে হচ্ছে, তেমনি গ্রাহকদেরও কিছুটা ধৈর্য রাখতে হচ্ছে। ঈদের আনন্দ যাতে অর্থনৈতিক দিক থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতায় না পড়ে, সে জন্য প্রয়োজন আরও সমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ