
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, যেসব কারণে অর্থ অনেক সময় অপ্রদর্শিত অবস্থায় পড়ে থাকে, সেসব পরিপ্রেক্ষিতে একটি সীমিত সুযোগ রেখে তা বৈধ করার পথ খোলা রাখা হয়েছে। তার ভাষায়, এটি একটি ‘এক্সিট রুট’ মাত্র—যার মাধ্যমে আগ্রহীরা কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের বৈধতা পেতে পারেন। তবে এবারের বাজেটে এই সুযোগ নিতে হলে আগের তুলনায় দ্বিগুণ কর পরিশোধ করতে হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বক্তব্য দেন এনবিআর চেয়ারম্যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অপ্রদর্শিত অর্থকে আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করার যে বিধান অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে রাখা হয়েছে, তার পেছনের যুক্তি তুলে ধরেন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও এ সময় উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিও এক পর্যায়ে স্বীকার করেন যে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা আদর্শ নয়।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে যেখানে বৈষম্যবিরোধী চেতনার কথা বলা হয়েছে, সেখানে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা কীভাবে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়? উত্তরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা বলছি না যে খুব ভালো জিনিস করে ফেলছি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় একটি নির্দিষ্ট পরিসরে এটি রাখা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, সরকার চায় না কেউ অনৈতিক পথে উপার্জিত অর্থ চিরতরে ব্যবহারের বাইরে থাকুক। তবে একই সঙ্গে এটি যাতে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, “আগে যেটা ছিল, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা বিধান ছিল। সেই সুযোগ আমরা নতুন সরকার আসার পরই বাতিল করে দিয়েছি। এরপর আরও একটি স্কিম ছিল, যেখানে কেউ বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনলে একটু বাড়তি কর দিলে সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না। সেটির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হচ্ছে এবং সেটিও আমরা বাড়াচ্ছি না।”
তিনি বলেন, নতুন যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটি আগের চেয়ে অনেক সীমিত এবং যৌক্তিক। এটি দু’ভাগে বিভক্ত—একজন যদি নিজের জমিতে বাড়ি নির্মাণ করতে চান এবং সেই অর্থ যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে থেকে আনা হয়, সেক্ষেত্রে বাড়তি কর দিয়ে সেই অর্থকে বৈধ ঘোষণা করার সুযোগ থাকছে।
“বাড়ি নির্মাণে বা আবাসন খাতে যাঁরা বিনিয়োগ করতে চান, তাঁরা অনেক সময় বিদেশ থেকে টাকা আনেন, কিন্তু বৈধ চ্যানেল দিয়ে আনেন না। নানা কারণে সেই অর্থ দেশে অপ্রদর্শিত অবস্থায় রয়ে যায়। ফলে তাদের জন্য যদি একটা এক্সিট রুট না রাখা হয়, তাহলে সেই অর্থ ব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকবে না। তাই আমরা বলেছি, দ্বিগুণ কর দিয়ে সেই অর্থ বৈধ ঘোষণা দিলে, এনবিআর বিষয়টি নিয়ে আর প্রশ্ন করবে না,”—বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
তবে এনবিআর চেয়ারম্যান পরিষ্কারভাবে বলেন, এনবিআর কর গ্রহণ করলেও এ অর্থের উৎস নিয়ে অন্য কোনো সংস্থা তদন্ত করতে চাইলে তা বন্ধ করা যাবে না। অর্থাৎ এনবিআর এক্ষেত্রে কোনো প্রতিরোধমূলক ধারা আরোপ করছে না।
“আমরা এটা বলছি না যে কেউ কর দিয়ে অর্থ বৈধ করলেই সেটি ভবিষ্যতে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে চলে যাবে। এনবিআর সে বিষয়ে আর প্রশ্ন করবে না, তবে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা চাইলে তারা তাদের নিজস্ব আইনে অনুসন্ধান করতে পারে,”—বলেন তিনি।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “অনেক প্রবাসী নাগরিক বৈধভাবে আয় করে থাকেন, কিন্তু সেটা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠান কিংবা দেশে এনে নিজ নামে জমি বা বাড়ি কেনেন না। এতে ওই অর্থ অপ্রদর্শিত হয়ে পড়ে থাকে। আবার কেউ কেউ ব্যবসার প্রসার ঘটাতে গিয়ে সম্পূর্ণ হিসাব রাখতে পারেন না। এদের জন্য কর দিয়ে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ রাখা মানে হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট পরিসরে রাষ্ট্র সেই অর্থকে উৎপাদনমূলক খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ সৃষ্টি করছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, এটি কোনো পুরস্কার নয়, বরং একটি শর্তসাপেক্ষ কর প্রদানের মাধ্যমে অতীতের কোনো ভুলের সংশোধন করতে দেওয়া সুযোগমাত্র।”
অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগ নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একদিকে দীর্ঘদিন ধরে সৎভাবে কর পরিশোধ করে যাওয়া নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করতে পারে, অন্যদিকে কালো টাকার মালিকদের জন্য এক ধরনের ‘সেফ প্যাসেজ’ তৈরি করে দেয়।
তবে সরকারের বক্তব্য হলো, ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বিগত এক দশকে যেসব সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তার তুলনায় এবার তা অনেক সীমিত, কঠোর এবং শর্তসাপেক্ষ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে সীমিত পরিসরে। দ্বিগুণ কর আরোপের মাধ্যমে এর অপব্যবহার রোধের চেষ্টা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে এনবিআর। যদিও নীতিগতভাবে এটি এখনো বিতর্কিত, তবে সরকারের যুক্তি হলো—অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নিয়ন্ত্রিত এবং কার্যকর এক্সিট রুট রাখা রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় প্রয়োজনীয়। তবে সেটি যাতে ন্যায়পরায়ণতা ও সুশাসনের পরিপন্থী না হয়, সেজন্য ভবিষ্যতে আরও কঠোর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ