
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় সহিংসতা ও মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র যেন প্রতিদিন নতুন মাত্রায় উন্মোচিত হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি এখন কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে নয়—বরং খাদ্যের আশায় জড়ো হওয়া ত্রাণ প্রত্যাশী, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর আক্রমণের মাধ্যমে ঘটছে। প্রতিদিনই দীর্ঘ লাইন, ক্ষুধার তাড়নায় অপেক্ষমাণ নারী, পুরুষ ও শিশুরা সামান্য কিছু খাবার বা তেল পাওয়ার আশায় জড়ো হন বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে। কিন্তু সেই মানবিক প্রয়াস এখন এক নির্মম মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।
মাত্র আট দিনের ব্যবধানে, ২৭ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে ইসরাইলি বাহিনীর চালানো গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০২ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৪৯০ জন। এসব আক্রমণ হয়েছে এমন সময়, যখন তারা খাদ্য সহায়তা নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নিহতদের সিংহভাগই ছিলেন নারী, শিশু ও বৃদ্ধ—যাঁরা কোনো সশস্ত্র সংঘাতে অংশ নেননি বরং বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কিছু খাবারের আশায় দাঁড়িয়েছিলেন।
গাজার মিডিয়া অফিস এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এটিকে ‘ইচ্ছাকৃত গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের ভাষ্য মতে, খাদ্যসামগ্রী বিতরণের অজুহাতে সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার এই ঘটনা একটি সুপরিকল্পিত কৌশলের অংশ। একইসঙ্গে, জাতিসংঘও এই ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত মৃত্যুফাঁদ’ বলে বর্ণনা করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলছে, ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে সহায়তা প্রদর্শন করে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হতে বাধ্য করা হচ্ছে, তারপর সেই স্থানে নির্বিচারে চালানো হচ্ছে গুলি ও বোমা হামলা।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ইতোমধ্যে রাফাহ শহরের একটি বিতরণকেন্দ্রে ২৭ ফিলিস্তিনির হত্যার ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। ওই একই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৯০ জন।
তবে ইসরাইল বরাবরের মতো এসব হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করে আসছে। তারা দাবি করছে, ‘ত্রাণ বিতরণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা’ বা ‘হামাসের উসকানি’ এই হতাহতের জন্য দায়ী। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এসব দাবি ভিত্তিহীন এবং ইসরাইল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইলের এই কৌশল নতুন নয়। মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা, ত্রাণকেন্দ্র লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা তাদের দীর্ঘদিনের একটি কৌশল, যার মাধ্যমে গাজা উপত্যকায় বসবাসরত জনগণকে নিঃশেষ করে ফেলা যায়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর এ পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৫৪ হাজার ৫১০ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ২৪ হাজার ৯০১ জন। যুদ্ধের প্রথমদিক থেকেই ইসরাইল গাজার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে, যাতে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি, বর্তমানে কুরবানির ঈদের আগে গাজায় কোনো পশু প্রবেশ করতে না দেওয়ায় এবারের ঈদে কুরবানি তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষদের ভাগ্যে এক টুকরা মাংসও জুটবে না।
জাতিসংঘ এবং রেড ক্রিসেন্টের মতো সংস্থাগুলো একাধিকবার সতর্ক করেছে যে, গাজায় দুর্ভিক্ষের প্রান্তে পৌঁছে গেছে লাখো মানুষ। শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ, এবং নারী ও বৃদ্ধদের জীবন এখন শুধুই প্রতিদিনের ‘বেঁচে থাকা’ রক্ষার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ।
এমন মানবিক বিপর্যয়ের মাঝেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিধান্বিত অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ যেমন—স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্লোভেনিয়া—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে বা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। স্পেন আরও একধাপ এগিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে ৩২৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি বাতিল করেছে। এই চুক্তির আওতায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি রাফায়েল থেকে ‘স্পাইক’ অ্যান্টিট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পরিকল্পনা ছিল, যেটি বাতিল করে দিয়েছে স্পেন সরকার।
এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স ও সৌদি আরব জাতিসংঘে ১৭ জুন একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে, যার মূল এজেন্ডা থাকবে 'দ্বিরাষ্ট্র সমাধান'। ধারণা করা হচ্ছে, ফ্রান্স ওই সম্মেলনে একতরফাভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। ফরাসি কূটনীতিকদের ভাষ্যমতে, যুক্তরাজ্যও এই পদক্ষেপে পাশে থাকতে পারে।
তবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর আপত্তি রয়েছে। ওয়াশিংটন গোপনে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে সতর্ক করে বলেছে, ফিলিস্তিনকে একতরফাভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তা ‘মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল’ করে দিতে পারে এবং ইসরাইলের সঙ্গে পশ্চিমা জোটের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে।
গাজায় খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের গুলি করে হত্যা করা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি একটি সভ্যতাবিরোধী অপরাধ। এই হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু একটি দেশের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ নয়, বরং এটি বিশ্ব বিবেকের পরীক্ষা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব, কতটা ন্যায়নিষ্ঠ অবস্থান নিতে পারবে?
যুদ্ধ যখন কেবল অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, খাদ্য ও সহানুভূতির অভাবের মাধ্যমেও পরিচালিত হয়—তখন তা হয়ে ওঠে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, যা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, পুরো বিশ্বের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। গাজার এই সংকট বিশ্বকে আবারও ভাবিয়ে তুলছে: মানবতার পক্ষে কে, আর কোন শক্তি এখনো নিরব?
বাংলাবার্তা/এমএইচ