
ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা সহ মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যুক্ত সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মূল রাজনৈতিক কাঠামো ছিল মুজিবনগর সরকার, আর সে কারণে এই সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।
বুধবার (৪ জুন) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর আলোকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও অংশগ্রহণকারীদের স্বীকৃতি নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি। তিনি যুদ্ধের সময় কারাগারে থেকেও আমাদের জাতীয় চেতনাকে জাগিয়ে রেখেছেন। তাঁর নির্দেশেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সুতরাং তিনি ছিলেন এই যুদ্ধের চূড়ান্ত নেতৃত্বে। জাতির পিতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার সুযোগ নেই।”
তিনি আরও বলেন, “জাতীয় চার নেতা— সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী—মুজিবনগর সরকারের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁরা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এজন্য এদের প্রত্যেককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।”
সরকার মঙ্গলবার রাতে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করেছে। রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে জারি করা গেজেটে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখা অনেক শ্রেণিপেশার মানুষকে "মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নতুন বিধানে যাঁরা সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা
মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, ডাক্তার ও নার্সরা
মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে পরবর্তীতে যুক্ত গণপরিষদ সদস্যরা
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী
দেশ ও বিদেশের মুক্তিযুদ্ধপন্থী সাংবাদিকরা
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা
এদেরকে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাঁরা যথাযথ যাচাই-বাছাই শেষে সরকার প্রদত্ত সনদপত্র পাওয়ার অধিকারী হবেন।
অনেকের মধ্যেই এই সংশোধিত সংজ্ঞা নিয়ে একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—‘সহযোগী’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ায় কি মর্যাদা কমে যাবে? এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, “পদবি পরিবর্তন হলেও তাঁদের মর্যাদায় কোনো কমতি আসবে না। সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি মানেই তারা মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সনদ, স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান সবই তাঁদের প্রাপ্য থাকবে।”
ফারুক ই আজম আরও বলেন, “যাঁরা তখন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, যেমন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা, তাঁদের অবদান অনন্য। কিন্তু যুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনে হয় না। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কূটনৈতিক যোগাযোগ, তথ্য যুদ্ধ, মনোবল সৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক প্রচারণা। এসব কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা যায় না।”
তিনি জানান, “এই অধ্যাদেশ শুধু সম্মান দেয়ার জন্য নয়, ইতিহাসের সঠিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধকে শুধুই রণাঙ্গনের ঘটনা মনে না করে, বরং এর নেতৃত্ব, দিকনির্দেশনা, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের দিকটিও উপলব্ধি করে।”
মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা জনসাধারণের মাঝে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা একে সময়োপযোগী ও ন্যায্য সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম বলেন, “এই স্বীকৃতি জাতির সঙ্গে সুবিচার। মুজিবনগর সরকার শুধু যুদ্ধ পরিচালনাই করেনি, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় অমূল্য ভূমিকা রেখেছে। এতদিন এদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা ছিল ইতিহাসের অসম্পূর্ণতা।”
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গ করতে গিয়ে এই সংশোধিত অধ্যাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুজিবনগর সরকারের নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণায় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পূর্ণতা পাচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের বৈচিত্র্যময় ও বহুস্তরীয় রূপ স্পষ্ট হবে এই উদ্যোগের মাধ্যমে। এটা শুধু স্বীকৃতির নয়, মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরার একটি জাতীয় প্রচেষ্টা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ