
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল হলো আম। রসালো, সুস্বাদু ও সবার প্রিয় এই ফল নিয়ে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা আছে—‘আম খেলেই মোটা হয়ে যাব।’ বছরের এই সময়টাতে অনেকেই আম খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে এই প্রশ্নটিই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করছেন: আম কি সত্যিই ওজন বাড়ায়? এই প্রশ্নের পেছনে রয়েছে কিছু বাস্তবতাও, আবার কিছু অমূলক ভয়ও। চলুন বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরভাবে জানি—পুষ্টিবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা ও মতামতের ভিত্তিতে।
আম খেলে মোটা হওয়ার ভয়—ভিত্তি কতটা?
আম খেলে মোটা হবেন কি না, তা নির্ভর করে আপনি কতটা আম খান, কখন খান এবং কীভাবে খান তার ওপর। অনেকেই মনে করেন আমে অনেক চিনি থাকায় এটি চর্বি হিসেবে শরীরে জমে এবং ওজন বাড়ায়। পুষ্টিবিদদের মতে, এই ধারণা আংশিক সত্য—যদি এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে অন্য ক্যালরি-সমৃদ্ধ খাবারও আগের মতো খাওয়া হয়।
পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম বলেন, “আমে কোলেস্টেরল না থাকলেও এতে শর্করার পরিমাণ বেশি। যখন আমরা অন্য খাবারও একইভাবে খাই এবং তার সঙ্গে আমও খাই, তখন আমাদের মোট দৈনিক ক্যালরি চাহিদা ছাড়িয়ে যায়। এই অতিরিক্ত ক্যালরি তখন আমাদের দেহে গিয়ে ফ্যাট হিসেবে জমে, ফলে ওজন বাড়ে।”
আমের পুষ্টিগুণ: শুধু চিনি নয়, উপকারও আছে
প্রতি ১০০ গ্রাম আমে ক্যালরি থাকে প্রায় ৭৯ থেকে ৮২ ক্যালরি। পাশাপাশি একটি আমে ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ পানি থাকে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে আমে কোনো কোলেস্টেরল নেই, এবং ক্ষতিকর কোনো লবণও নেই। ফলে এটি হূৎপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং বেশ উপকারীই বলা যায়।
তবে, যেহেতু এতে প্রাকৃতিক চিনি বা শর্করার পরিমাণ তুলনামূলক বেশি, তাই এটি খাওয়ার সময় হিসাব রাখতে হয়। যেমন ধরুন, কেউ যদি প্রতিদিন দুই-তিনটি বড় আম খান, আবার আগের মতোই ভাত, রুটি, আলু, মিষ্টি খান—তাহলে অবশ্যই অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে জমবে এবং সেই ক্যালরি থেকে ওজন বৃদ্ধি ঘটতে পারে।
ক্যালরি ভারসাম্যই আসল কৌশল
এই বিষয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, “আমে যেহেতু ক্যালরি অনেক, তাই বেশি আম খেলে ওজন বেড়ে যাবে। যাদের ওজন আগে থেকেই বেশি, তারা কম আম খাবেন। আর কেউ যদি আম খান, তবে তার জায়গায় অন্য কিছু বাদ দিতে হবে। যেমন, দুপুরে আম খেলেন, তাহলে ভাত খাবেন না। তাহলে মোট ক্যালরি চাহিদা ঠিক থাকবে।”
তার মতে, প্রতিদিনের খাবারে যদি পরিকল্পিত পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে আম খেয়ে মোটা হওয়ার ভয় নেই। আমকে যদি একটি মিল রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে খাওয়া যায়—অর্থাৎ এক বেলা ভাত বা রুটির পরিবর্তে আম—তাহলে শরীরের জন্য ক্ষতির বদলে উপকারই হবে।
ভুল ধারণা ভাঙুন, বিজ্ঞানসম্মতভাবে আম খান
আজকের দিনে, অনেকেই স্রেফ “আমে ক্যালরি বেশি”—এই যুক্তিতে আমকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেন তাদের ডায়েট থেকে। এটি এক ধরনের ভুল স্বাস্থ্যবোধ। পুষ্টিবিদদের মতে, যেকোনো খাদ্যই অতিরিক্ত খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু যদি তা পরিমিতভাবে খাওয়া হয় এবং দৈনিক ক্যালরি চাহিদার মধ্যে রাখা হয়, তাহলে সেটি শরীরের জন্য বিপদ নয়।
সামিয়া তাসনিম বলেন, “আম খাওয়া যাবে না—এই ধারণাটি ভুল। বরং বুঝেশুনে খেলে এটি শরীরের জন্য ভালো। তবে কেউ যদি দিন শেষে আম খেয়ে তার সঙ্গে মিষ্টি, ডেজার্ট, ভাত বা রুটি আগের মতোই খান, তখনই সমস্যা হয়। অর্থাৎ ক্যালরির হিসাব রাখতে হবে।”
দৈনিক কতটুকু আম খাওয়া নিরাপদ?
একজন সুস্থ, স্বাভাবিক ওজনের মানুষ দৈনিক ১–২টি মাঝারি আকারের আম খেতে পারেন—যদি সেটি তার দৈনিক মোট ক্যালরি চাহিদার মধ্যে রাখা হয়। তবে যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য এই পরিমাণ আরও কম হতে পারে।
এটি নির্ভর করে:
ব্যক্তির ওজন ও উচ্চতা
শরীরচর্চার মাত্রা
ডায়াবেটিস বা মেটাবলিক রোগ আছে কি না
যদি কেউ এমন একজন হন, যিনি সকালের নাস্তায় দুটো রুটি খেতেন, তিনি চাইলে একটি রুটির পরিবর্তে একটি আম খেতে পারেন। এতে করে অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে ঢুকবে না, আবার আম খাওয়ার আনন্দটাও উপভোগ করা যাবে।
আম খাবেন, তবে বুঝে-শুনে
‘আম খেলেই মোটা হয়ে যাব’—এই কথাটি সামগ্রিকভাবে সত্য নয়, তবে অতিরিক্ত খাওয়া হলে অবশ্যই ওজন বাড়ার ঝুঁকি আছে। মূল কথা হলো: ক্যালরি ইন আর ক্যালরি আউটের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। খাদ্যতালিকায় আম রাখতে হলে সেই অনুযায়ী অন্য ক্যালরি-সমৃদ্ধ খাবার কিছুটা কমিয়ে নিতে হবে।
পরিমিত আম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, এবং তা শরীরে কেবল চর্বি জমাবে না, বরং প্রাকৃতিক চিনি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে আপনাকে রাখবে সজীব ও প্রাণবন্ত।
স্মরণ রাখুন:
খাদ্য কখনো শত্রু নয়—অবিবেচনা ও অতিরিক্ততাই শত্রু।
আপনি যদি সচেতনভাবে খাদ্য বেছে খান, তাহলে আমও আপনার বন্ধু হতে পারে, শত্রু নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ