ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ নারী দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স যেন সাহস, প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাসের নতুন সংজ্ঞা। একের পর এক ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বহু ধাপ এগিয়ে থাকা প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে কোচ পিটার বাটলারের শিষ্যরা। এক সপ্তাহ আগেই ৩৯ ধাপ এগিয়ে থাকা ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করেছিল বাংলাদেশ নারী দল। আর সর্বশেষ ম্যাচে, আরও বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে, ৫৯ ধাপ এগিয়ে থাকা স্বাগতিক জর্ডানকেও রুখে দিয়েছে তারা—তাও আবার দুইবার পিছিয়ে পড়েও দারুণভাবে ম্যাচে ফিরে এসে।
গতকাল রাতের ম্যাচে ২-২ গোলের ড্র করে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ। এই ম্যাচটি কেবল একটি পয়েন্ট অর্জনের গল্প নয়, বরং এটি একটি সাহসী লড়াইয়ের, মানসিক দৃঢ়তার, এবং আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের জন্য।
ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে জর্ডান রয়েছে ৭৪ নম্বরে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৩তম স্থানে। এই র্যাঙ্কিং ব্যবধানের পার্থক্যই বোঝায় জর্ডান কতটা শক্তিশালী দল, যারা ২০২১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৫-০ গোলে জিতেছিল। ফলে ম্যাচের আগে স্বাভাবিকভাবেই ধরা হয়েছিল বাংলাদেশ হয়তো খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ছিল আরও বেশি সংগঠিত, বেশি লড়াকু এবং কৌশলে তীক্ষ্ণ।
ম্যাচের মাত্র ৫ মিনিটেই গোল হজম করে বসে বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে রক্ষণে কিছুটা ভুল হয়, আর সেখান থেকেই গোল করে এগিয়ে যায় জর্ডান। তবে গোল খাওয়ার পর বাংলাদেশের মেয়েরা যেন আরও বেশি দৃঢ়তায় ম্যাচে ফিরে আসে।
মাঝমাঠে মারিয়া মান্দা ও ঋতুপর্ণা চাকমা বারবার বলের নিয়ন্ত্রণ আদায় করে নিয়েছেন, তৈরি করেছেন আক্রমণের সুযোগ। আর সেই সুযোগেরই ফসল মেলে প্রথমার্ধের শেষদিকে। ৪৩ মিনিটে শামসুন্নাহার জুনিয়র দারুণ এক শট নিয়ে জর্ডানের জালে বল পাঠিয়ে দেন। ম্যাচে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। এরপর প্রথমার্ধ শেষ হয় ১-১ গোলে।
দ্বিতীয়ার্ধে শুরুতেই বাংলাদেশ কিছুটা চাপে পড়ে। স্বাগতিকরা আক্রমণের ধার বাড়ায় এবং ৫৮ মিনিটে আবারও গোল আদায় করে নেয়। ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ।
কিন্তু এরপরও হাল ছাড়েনি লাল-সবুজের মেয়েরা। রক্ষণে রুপনা চাকমা দুর্দান্ত কয়েকটি সেভ করে ম্যাচে দলকে টিকিয়ে রাখেন। মাঝমাঠ ও উইংয়ে তীব্র গতি ও পাসিং ফুটবলে প্রতিপক্ষের রক্ষণে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে বাংলাদেশ। এই চাপই ৮২ মিনিটে গোল এনে দেয়। শাহেদা আক্তার রিপা ডান দিক থেকে আসা পাস পেয়ে ডি-বক্সের ভেতর থেকে শটে গোল করে সমতা ফেরান।
বাকি সময়টুকু দু'দলই আরও একটি গোলের জন্য লড়াই করলেও গোল হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।
এ ম্যাচ কেবল মাঠের ফলাফলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর পেছনে ছিল একটা জটিল প্রেক্ষাপট। বেশ কিছুদিন ধরে নারী ফুটবলে কোচ পিটার বাটলারের অধীনে ১৮ জন সিনিয়র খেলোয়াড় অনুশীলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। ফলে দুবাই সফরে সেই খেলোয়াড়দের ছাড়া ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ, যেখানে দুই ম্যাচেই পরাজিত হয়েছিল।
তবে এই সিরিজে বাটলার নতুন করে গড়ে তোলেন দল। সেই বিদ্রোহী দলে থাকা কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে পুনরায় দলে নেন তিনি—ঋতুপর্ণা চাকমা, রুপনা চাকমা, মারিয়া মান্দা এবং শামসুন্নাহার জুনিয়র। এই চারজনই মূলত দলের কাণ্ডারি হিসেবে নিজেদের কাজ করে গেছেন। তারা শুধু দলে ফিরেই নয়, পারফরম্যান্সেও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।
তবে সাবেক অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, সানজিদা আক্তার, মাতসুশিমা সুমাইয়া এবং মাসুরা পারভীনকে এখনও দলের বাইরে রাখা হয়েছে। এই পাঁচজনই নারী ফুটবলের উজ্জ্বল মুখ, যারা দেশের বহু অর্জনের সঙ্গে জড়িত। তাদের ছাড়া এমন একটি ফল বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশ নারী দলের সামনে রয়েছে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের মিশন। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সেই বাছাইপর্বের আগে জর্ডানে এই দুই ম্যাচের সিরিজটা ছিল প্রস্তুতি হিসেবে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। ৩১ মে প্রথম ম্যাচে গোলশূন্য ড্র, এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে ২-২ গোলের লড়াকু ড্র—এই ফলাফল দলকে আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছে।
এই পারফরম্যান্স কেবল পরিসংখ্যানের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি এক নতুন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত, যেখানে নারীরা কেবল খেলবে না, বরং শক্তিশালী দলগুলোকেও চ্যালেঞ্জ জানাবে।
নারী ফুটবলে বাংলাদেশ যতদূর এসেছে, ততদূর পৌঁছাতে বহু লড়াই করতে হয়েছে। আর এখন যেন সময় এসেছে সেসব লড়াইয়ের ফলাফল কুড়ানোর। কোচ পিটার বাটলার যখন নতুন দল গঠনের সাহসিকতা দেখালেন, তখন সেই সাহসিকতার ফলও মিলল মাঠে। ৫৯ ধাপ এগিয়ে থাকা দলকে রুখে দিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা বুঝিয়ে দিলেন, র্যাঙ্কিং দিয়ে মানসিকতা মাপা যায় না।
এই ম্যাচ ভবিষ্যতের জন্য শুধু অনুপ্রেরণা নয়, বরং এক পথচিহ্ন—যেখানে লড়াই, ঐক্য আর সাহসই সাফল্যের একমাত্র ঠিকানা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



