
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাধর সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদে ২০২৬-২০২৭ মেয়াদের জন্য পাঁচটি নতুন দেশকে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। নির্বাচিত দেশগুলো হলো—বাহরাইন, কলম্বিয়া, কঙ্গো, লাটভিয়া এবং লাইবেরিয়া। এই দেশগুলো আগামী দুই বছর ধরে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটির মাধ্যমে এই সদস্যদের নির্বাচন চূড়ান্ত করা হয়।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ হচ্ছে সেই একমাত্র আন্তর্জাতিক সংস্থা, যার সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। পরিষদ যেকোনো রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সামরিক হস্তক্ষেপ অনুমোদন, শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনা এবং আন্তর্জাতিক সংঘাত নিরসনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। পরিষদে রয়েছে মোট ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র—এর মধ্যে ৫টি স্থায়ী, বাকিগুলো অস্থায়ী।
স্থায়ী পাঁচ সদস্য—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স—তাদের প্রত্যেকের রয়েছে ভেটো ক্ষমতা, যার ফলে তারা যে কোনো প্রস্তাব আটকে দিতে পারে। অন্যদিকে, ১০টি অস্থায়ী সদস্য দেশকে দুই বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করা হয়, যার অর্ধেক প্রতিবছর পরিবর্তিত হয়। এই নিয়মিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
নতুন নির্বাচিত পাঁচটি দেশ নির্ধারিত আঞ্চলিক গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করে। নিরাপত্তা পরিষদের আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অঞ্চলভিত্তিক গ্রুপ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে মনোনয়ন পেলেই নির্বাচন নিশ্চিত হয় না। প্রতিটি দেশকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উপস্থিত দেশগুলোর অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট পেতে হয়।
এবারের ভোটাভুটিতে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে বাহরাইন—১৮৬টি দেশের ভোট। এরপর রয়েছে কঙ্গো (১৮৩), লাইবেরিয়া (১৮১), কলম্বিয়া (১৮০) এবং লাটভিয়া (১৭৮)। এই পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে স্থলাভিষিক্ত হবে বিদায়ী অস্থায়ী সদস্য আলজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, দক্ষিণ কোরিয়া, গায়েনা এবং স্লোভেনিয়ার।
নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হওয়ার মানে কেবল একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ নয়, বরং এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কূটনৈতিক কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রভাব এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা ইস্যুতে অবস্থান স্পষ্ট করার সুযোগ তৈরি হয়। যদিও স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা না থাকায় অস্থায়ী সদস্যরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এককভাবে নিয়ামক হতে পারে না, তথাপি তারা আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারে, প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে এবং ভোট দিতে পারে।
বিশেষ করে ইসরায়েল-গাজা সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সুদান সংকট কিংবা হাইতিতে নিরাপত্তা পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নতুন নির্বাচিত দেশগুলোর মধ্য থেকে কেউ কেউ এসব ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে।
বাহরাইন: মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্ষুদ্র উপসাগরীয় দেশটি প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচিত হলো। উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরব-ইরান উত্তেজনা এবং ইয়েমেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাহরাইনের অবস্থান ও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
কলম্বিয়া: লাতিন আমেরিকার দেশটি আগেও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফার্ক বিদ্রোহের শান্তি চুক্তি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসঙ্গে কলম্বিয়া একটি শান্তি-প্রতিষ্ঠাকারী দেশের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে।
কঙ্গো (কঙ্গো-ব্রাজাভিল): মধ্য আফ্রিকার দেশ হিসেবে কঙ্গোর নির্বাচিত হওয়া মহাদেশটির শান্তি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি, বিশেষত কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের সহিংসতা ও হ্রাসমান স্থিতিশীলতার বিষয়ে আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করবে।
লাটভিয়া: বল্টিক অঞ্চলের এই দেশটি পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া সংক্রান্ত ইস্যুতে পশ্চিমা অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লাটভিয়ার নিরাপত্তা ভাবনা এবং প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
লাইবেরিয়া: আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের এই দেশটি একসময় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের শিকার হলেও এখন শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। লাইবেরিয়ার সদস্য হওয়া এক অর্থে আফ্রিকার শান্তিরক্ষার ইতিহাসের প্রতিফলনও।
এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিনেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। আগামী সেপ্টেম্বরে শুরু হতে যাওয়া ৮০তম অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবোক। তার নেতৃত্বে আগামী বছরের জাতিসংঘ অধিবেশন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যু ও মানবাধিকার প্রশ্নে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। অস্থায়ী সদস্য দেশগুলো যদিও স্থায়ী সদস্যদের মতো ভেটো ক্ষমতা রাখে না, তবুও বৈশ্বিক আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তারা নীতিগত অবস্থান, সংহতি এবং বিকল্প মতামত তুলে ধরতে পারে। বাহরাইন, কলম্বিয়া, কঙ্গো, লাটভিয়া ও লাইবেরিয়ার এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক সংলাপে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিনিধিত্ব আনবে—এমনটাই প্রত্যাশা করছে বিশ্ব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ