
ছবি: সংগৃহীত
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবারের জন্য অপেক্ষমাণ শতাধিক ফিলিস্তিনির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নিহত ও আহতদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য আসছে। তবে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই ঘটনায় “গভীর মর্মাহত” উল্লেখ করে দ্রুত ও স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তিনি একইসঙ্গে দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বানও জানিয়েছেন।
রোববার (১ জুন) গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (Gaza Humanitarian Foundation - GHF) পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনি খাবার সংগ্রহের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। এই সংস্থাটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমর্থনপুষ্ট একটি এনজিও, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদান করছে।
স্থানীয় সময় দুপুরের দিকে ওই কেন্দ্রে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) জানায়, আহতদের অনেকেই রাফার ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। এর মধ্যে ২১ জনকে ঘটনাস্থলেই মৃত ঘোষণা করা হয়। হামাস-নিয়ন্ত্রিত সিভিল ডিফেন্স সংস্থার তথ্যমতে, নিহতের সংখ্যা ছিল ৩১ জন। হতাহতদের মধ্যে বহু নারী ও শিশুও রয়েছে।
ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বহু ফিলিস্তিনি বালুর মাঠে দিকবিদিক ছুটোছুটি করছে এবং আশপাশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে ভিডিওতে পর্যাপ্ত ভৌগোলিক চিহ্ন না থাকায় বিবিসি সেটির অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি।
ঘটনার একদিন পর, সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “রোববার গাজায় খাবার চাইতে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিহত ও আহত হওয়ার খবরে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমি এই ঘটনার তাৎক্ষণিক, নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে সত্য উদ্ঘাটন হয় এবং দোষীরা জবাবদিহির মুখোমুখি হয়।”
এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'এক্স' (সাবেক টুইটার)-এ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা গুতেরেসের বক্তব্যকে “অপমানজনক” বলে উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলে কেন তিনি হামাসের নাম উল্লেখ করেননি।
ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) ঘটনার পরপরই একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, তাদের সেনারা ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে বা তার অভ্যন্তরে কোনো ধরনের গুলি চালায়নি। আইডিএফ মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন বলেন, “প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী দেখা গেছে, সেনারা কোনো গুলি চালায়নি। এসব খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গাজার জনগণকে সাহায্য থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র।” তিনি আরও বলেন, “হামাস এই ঘটনার জন্য দায়ী। তারা মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে এবং জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সেগুলো থেকে দূরে রাখতে চাইছে।”
GHF-ও এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ স্থাপনায় বা আশপাশে কোনো ধরনের হামলা বা সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারা এসব প্রতিবেদনকে “সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট” বলে অভিহিত করে।
ঘটনার পর রেড ক্রস এবং মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) গাজায় গুরুতর আহতদের চিকিৎসা দেয়। এমএসএফ জানায়, খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে তাদের টিম বহু আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এমএসএফ আরও জানায়, “রোগীরা জানিয়েছে তারা ত্রাণ নিতে এসেছিল। হঠাৎ করেই ড্রোন, হেলিকপ্টার, ট্যাংক এবং স্থল সেনাদের দিক থেকে গুলি শুরু হয়।” তাদের এক কর্মীর ভাইও গুলিতে নিহত হয়েছেন, যিনি ত্রাণ সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন।
বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাফার স্থানীয় একজন সাংবাদিক জানান, “রাফার আল-আলম গোলচত্বর এলাকায় ফিলিস্তিনিরা জিএইচএফের কেন্দ্রের কাছে জড়ো হয়েছিল। তখন হঠাৎ করে ইসরাইলি ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে আসে এবং গুলি চালাতে শুরু করে।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও এবং সাক্ষাৎকারগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত হামলা। তবে যথাযথ অনুসন্ধান ও প্রমাণ ছাড়া জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো সরাসরি দায়ী করার পরিবর্তে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানাচ্ছে।
এই ঘটনা এমন এক সময় ঘটলো যখন গাজার মানবিক পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের কারণে গাজায় অন্তত ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধের সংকট চরমে পৌঁছেছে।
তীব্র যুদ্ধের মধ্যেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে ভিড় করছে। অথচ এসব কেন্দ্রেই হামলার ঘটনা ঘটছে, যার ফলে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হচ্ছে।
রাফার এই ঘটনা শুধু একটি দুঃখজনক মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাব্য উদাহরণ হিসেবেও উঠে আসছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের স্বাধীন তদন্তের আহ্বান আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে ইসরাইলি বাহিনীর অস্বীকৃতি, পাল্টা অভিযোগ এবং ঘটনার প্রমাণ অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
সত্য উদঘাটনের জন্য অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত জরুরি, যেন আহত ও নিহতদের পরিবার সুবিচার পায় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।
সূত্র: বিবিসি, আইসিআরসি, এমএসএফ, জাতিসংঘ
বাংলাবার্তা/এমএইচ