
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গত ৭ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ২৫ দিনে বাংলাদেশের ভেতরে এক হাজার ২২১ জনকে জোর করে ঠেলে (পুশ ইন) দিয়েছে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ও সীমান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। পুশ ইন প্রক্রিয়ায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ সরকারের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে 'অবৈধ ভারতীয়দের' পুশ ব্যাক শুরু করার ঘোষণা এই সংকটকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
সীমান্তে অব্যাহত পুশ ইন: কোথায় কী ঘটছে?
বিএসএফ মৌলভীবাজার জেলার তিনটি সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি পুশ ইন ঘটিয়েছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুজিবনগর, রামগড়, ফেনী, কুমিল্লা ও সাতক্ষীরাসহ অন্তত ১৮টি সীমান্তবর্তী জেলা এই জোরপূর্বক অনুপ্রবেশের শিকার হয়েছে।
১৭ মে: ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে ১৮ জনকে পুশ ইন করে বিএসএফ।
২২ মে: খাগড়াছড়ির রামগড়ের কাছে ফেনী নদী থেকে উদ্ধার হয় ৫ জনের একটি পরিবার, যাদের রাতভর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
২৭ মে: রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ১৪ জনকে পুশ ইন করে ভারত।
মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন: ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ
পুশ ইন প্রক্রিয়ায় নিপীড়নের যে চিত্র উঠে এসেছে তা মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ দেয়।
৪১ বছরের সেলিনা বেগমের কাহিনী হৃদয়বিদারক। তাকে ও তার তিন মেয়েকে গভীর রাতে কোমরে প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সারা রাত নদীতে ভেসে থাকার পর স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে।
একইভাবে আসামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খাইরুল ইসলামকে তার দেশীয় বাসভবন, জমি ও পরিচয় থাকা সত্ত্বেও জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। তিনি জানান, "আমার মা, ভাই স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার হলেও আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে।"
এছাড়া বিএসএফ সদস্যরা নির্যাতনের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয় কীভাবে বিজিবির কাছে ধরা পড়লে জবাব দিতে হবে।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, যারা পুশ ইন হতে রাজি হয়নি তাদের মারধর করা হয়। “তোর ঘরত পৌঁছাই দিইম” বলে হুমকি দেওয়া হয় আসামের আঞ্চলিক ভাষায়।
ধরার আগেই অনেকে কলকাতা পর্যন্ত বিমান ভ্রমণের পর ট্রেনে করে সীমান্তে এনে পুশ ইন করা হয়। যেমন, যশোরের নুরুন্নাহারকে মুম্বাই থেকে আটক করে কলকাতা হয়ে ঠাকুরগাঁও সীমান্তে পাঠানো হয়।
পুশ ব্যাক শুরু করেছে বাংলাদেশ
এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার ‘অবৈধ ভারতীয়দের’ পুশ ব্যাক প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম মেনে হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী:
"ভারত পুশ ইন করছে অবৈধভাবে, কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই। আমরা পুশ ব্যাক করছি নিয়ম অনুযায়ী।"
কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার চেষ্টা ও হতাশা
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, বারবার পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানালেও বিএসএফ সাড়া দিচ্ছে না। সীমান্তে প্রায় ২৬টি 'হটস্পট' চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে জঙ্গল বা দুর্গমতা থাকার সুযোগে বিএসএফ পুশ ইন চালিয়ে যাচ্ছে।
পুশ ইন ঠেকাতে বৈঠক ও কূটনৈতিক কঠোরতা
বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে ১ জুন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক করেছে। বৈঠকে কূটনৈতিকভাবে ভারতের কাছে আপত্তি জানানো এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা
নিরাপত্তা ও অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, পুশ ইন বন্ধে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ না নিলে ভারত আরও উৎসাহিত হতে পারে। তারা সতর্ক করেছেন যে:
আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে আবার ‘বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণ’ অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ভারত।
অতীতে যেভাবে মনগড়া তালিকা ধরে বাঙালিদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, সেটি নতুনভাবে ফিরে আসতে পারে।
পুশ ইনকে আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় হিসেবে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
সীমান্তে পুশ ইন একটি কেবল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যু নয়, এটি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন, এবং মানবাধিকারের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ। বিএসএফ-এর আচরণ একদিকে যেমন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে মানুষের মৌলিক অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত। এর সমাধান কেবল সীমান্ত পাহারা বাড়িয়ে হবে না, বরং এর জন্য দরকার কূটনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ ও অভ্যন্তরীণ ঐক্য।
বাংলাদেশকে এখন একদিকে যেমন সীমান্তে সজাগ থাকতে হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক ফোরামে এই ঘটনা তুলে ধরে ভারতের উপর চাপ বাড়ানো জরুরি। নয়তো মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ