
ছবি: সংগৃহীত
রাজনীতিতে বহুমাত্রিক মতপার্থক্যের মাঝেও একটি গ্রহণযোগ্য ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরির প্রয়াসে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু করেছে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন। আজ মঙ্গলবার (৩ জুন) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এই সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা চাই এমন কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অন্তত ন্যূনতম পর্যায়ের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে এবং সেগুলো সংরক্ষণ করা যায়। সেটাই এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য।”
এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপে দেশের মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট অংশগ্রহণ করে, যার মধ্যে রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি প্রভৃতি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, এবং গণতান্ত্রিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে এই সংলাপকে জাতীয় ঐকমত্যের সম্ভাব্য সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ও আদর্শগত অবস্থানকে সম্মান জানিয়ে আলী রীয়াজ স্পষ্ট করে বলেন, “কিছু বিষয়ে হয়তো একমত হওয়া যাবে না, তবে প্রত্যেক দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থান, দলীয় ইশতেহার এবং রাজনৈতিক অভিপ্রায় ধরে রাখবে। তবে কোনো দল যদি অতিরিক্ত কিছু যুক্ত করতে চায়, তাদের সেই মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকবে।”
সম্মিলিত সংলাপের পথ: আলাদা আলাপে নয়, একত্রে আলোচনা
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “জাতীয় সনদে আমরা কেবলমাত্র সেসব প্রস্তাবই অন্তর্ভুক্ত করতে চাই, যেগুলোতে আপনাদের সম্মতি থাকবে। আমরা আলাদাভাবে প্রতিটি দলের সঙ্গে আলোচনা না করে সম্মিলিত সংলাপের পথ বেছে নিয়েছি, যাতে পারস্পরিক যুক্তি-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে। সেই বিবেচনায় একটি কাঠামো দাঁড় করাতে চাই আমরা।”
এই কাঠামোগত উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন দলের পারস্পরিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও একটি সর্বসম্মত ভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। আলোচনার জন্য যেসব বিষয় নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ (দলীয় শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধান), সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, স্থায়ী সংসদীয় কমিটির কার্যকারিতা, সরকারের মেয়াদ এবং এগুলোকে কীভাবে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়।
রীয়াজ আরও বলেন, “প্রতিটি বিষয়ে একমত হওয়া না গেলেও, আমাদের কিছু উপসংহার টানতেই হবে—বিশেষ করে সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে। আমাদের লক্ষ্য হলো জুলাই মাসের মধ্যে জাতীয় সনদটি চূড়ান্ত করা।”
আলোচিত হলেও অন্তর্ভুক্ত নয়—প্রস্তাবগুলোর পৃথক তালিকা থাকবে
তিনি এ-ও জানান, সংলাপে যেসব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও সম্মিলিত ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে না, সেগুলোও জাতীয় সনদে ‘আলোচিত হলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি’—এই বিবেচনায় আলাদাভাবে উল্লেখ করা হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কমিশন ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে চায়, যাতে পরবর্তী সময়ে ঐসব বিষয়ে নতুন করে আলোচনার সুযোগ থাকে।
বিভিন্ন মহলের সক্রিয় অংশগ্রহণ
সংলাপের সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। উপস্থিত ছিলেন কমিশনের অন্যান্য সদস্য—সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, সুপরিচিত নাগরিক সমাজ প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবী ড. বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
উল্লেখ্য, এর আগে অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের সংলাপে অংশ নেয়নি অনেক রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বড় দুটি জোট—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে দ্বিতীয় ধাপে এই ব্যাপক অংশগ্রহণ রাজনৈতিক অঙ্গনে আশার সঞ্চার করেছে।
নির্বাচন সামনে রেখে ঐকমত্যের তাগিদ বাড়ছে
চলতি বছরের শেষ দিকে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা আবারও বাড়ছে। এর মধ্যেই অনেক রাজনৈতিক দল ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন চায় বলে মতামত জানিয়েছে, যা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই ঐক্যমত্য কমিশনের উদ্যোগ কেবল একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারে। ন্যূনতম সম্মত বিষয়গুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে আগামী দিনের রাজনীতি কিছুটা হলেও সহনশীল এবং যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে পারে—এই প্রত্যাশায় রয়েছে অনেকেই।
এখন দেখার বিষয়, এই সংলাপ থেকে বেরিয়ে আসা খসড়া জাতীয় সনদ কেমন হয় এবং তাতে কতটা বাস্তব সম্মত ও গ্রহণযোগ্য বিষয় যুক্ত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ও গঠনমূলক অংশগ্রহণের ওপরই নির্ভর করছে এই ঐক্যমত্য প্রয়াসের সফলতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ