
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ও চোরাচালান প্রতিরোধে এবার নেওয়া হচ্ছে যুগান্তকারী উদ্যোগ। অবৈধ স্বর্ণ ও অন্যান্য চোরাচালানি পণ্য শনাক্তে বিমানবন্দরের প্রতিটি স্তরে বসানো হবে অত্যাধুনিক ভেহিক্যাল স্ক্যানার, হিউম্যান বডি স্ক্যানার, ব্যাগেজ স্ক্যানার, এআই-চালিত ফেসিয়াল রিকগনিশন সিসিটিভি, আরএফআইডি লক এবং যাত্রী শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এপিআই)। সবকিছু মিলিয়ে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বারে আসছে এক বিশাল প্রযুক্তিগত রূপান্তর।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের পক্ষ থেকে এসব উদ্যোগের একটি বিস্তারিত প্রস্তাবনা সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে। তিন মাসব্যাপী গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি এ প্রস্তাবনায় দেশের বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক মানকে সমন্বয় করে তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পনা। লক্ষ্য—শূন্য সহনশীলতা ভিত্তিক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং একটি সেবাধর্মী, আধুনিক কাস্টমস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, “আমরা গত তিন মাস ধরে শাহজালাল বিমানবন্দরের দুর্বলতা, সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস নিয়ে গবেষণা করেছি। এর ফলাফল হিসেবে ৬টি বড় কৌশলগত পরিকল্পনা এনবিআরে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে শুধু চোরাচালান বন্ধ হবে না, যাত্রীসেবা এবং নিরাপত্তাও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে।”
পরিকল্পনার ৬টি স্তম্ভ: কী কী প্রযুক্তি আসছে?
১. ব্যাগ স্ক্যানিং আধুনিকায়ন: এয়ারসাইডে স্ক্যানার বসবে: বর্তমানে ব্যাগ স্ক্যান করা হয় যাত্রীদের প্রবেশপথের (ল্যান্ডসাইড) কাছে। এতে অনেক ব্যাগ নজর এড়িয়ে যায়। নতুন পরিকল্পনায় টার্মিনাল ১ ও ২-এ ব্যাগেজ বেল্টের এয়ারসাইড অংশে অত্যাধুনিক স্ক্যানার বসানো হবে, যাতে ব্যাগ ওঠানোর আগেই সব পণ্য স্ক্যান হয়। এর জন্য ইতোমধ্যে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়েছে।
২. ডাইভার্টিং বেল্টের বদলে আরএফআইডি লক প্রযুক্তি: শাহজালালে আগে থেকে ‘ডাইভার্টিং বেল্ট’ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সন্দেহজনক ব্যাগ আলাদা করার প্রক্রিয়ায় জটিলতা হতো। এখন প্রস্তাব এসেছে—সন্দেহজনক ব্যাগে স্ক্যানিংয়ের পরপরই আরএফআইডি লক লাগিয়ে দেওয়া হবে। যাত্রী কাস্টমস হল অতিক্রমের সময় সেই ব্যাগ আরএফআইডি গেট সনাক্ত করে সতর্ক বার্তা পাঠাবে কাস্টমস কর্মকর্তাকে। এর ফলে যাত্রী হয়রানি ছাড়াই, শুধু সন্দেহভাজন ব্যাগকে নজরদারিতে রাখা সম্ভব হবে।
৩. ১০টি হিউম্যান বডি স্ক্যানার স্থাপন: চোরাকারবারিরা এখন ব্যাগের বদলে শরীরে বা হাতে বহনযোগ্য ব্যাগে চোরাচালান করে থাকেন। এই প্রবণতা রুখতে টার্মিনাল ১ ও ২-এর গ্রিন চ্যানেল, ভিআইপি গেট এবং নতুন টার্মিনাল-৩-তে মোট ১০টি বডি স্ক্যানার বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
“শরীরের ভেতর স্বর্ণ ও অন্যান্য পণ্য বহন রোধে বডি স্ক্যানারই একমাত্র সমাধান,” বললেন অভ্যন্তরীণ কাস্টমস নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) জাফর সাদেক। “বিশেষ করে স্বর্ণ পাচারের নতুন নতুন কৌশলকে ধরতে হলে শরীর স্ক্যানের বিকল্প নেই।”
৪. এপিআই (Advance Passenger Information) সিস্টেম চালু: অনেক দেশ আগেই এই পদ্ধতি চালু করেছে—যার মাধ্যমে ফ্লাইট ওঠার আগেই যাত্রীর পাসপোর্ট, জাতীয়তা, রুট, পেমেন্ট মেথডসহ নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রীদের চিহ্নিত করা হয়। এখন শাহজালালে এই প্রযুক্তি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন এই সিস্টেম বাস্তবায়নে কিছু অগ্রগতি করেছে। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চায়, এনবিআর নিজেই প্রয়োজনে এটির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করুক।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও এভিয়েশন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. তানভীর মাহমুদ বলেন, “এপিআই এমন একটি ব্যবস্থা, যেটা শুধু কাস্টমস নয়, গোয়েন্দা সংস্থার জন্যও অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ বা সন্দেহজনক যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণে এটি একটা গেমচেঞ্জার।”
৫. এআই বেইজড ফেসিয়াল রিকগনিশন সিসিটিভি স্থাপন: বর্তমানে টার্মিনাল ১ ও ২-এ ৮টি প্লেনে একসঙ্গে প্রায় ৪ হাজার যাত্রী নামেন। সেখানে চেক করার সক্ষমতা থাকে ২–৩ শ’ যাত্রীর। টার্মিনাল-৩ চালু হলে তা আরও জটিল হবে—৮ হাজার যাত্রীর বিপরীতে চেক করা যাবে মাত্র ২৫০ জনকে। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে প্রস্তাব এসেছে এআই-চালিত ফেসিয়াল রিকগনিশন সিসিটিভি ব্যবহারের। এতে নিয়মিত যাত্রী, পরিচিত অপরাধী, বা হাই-রিস্ক প্রোফাইল সহজে শনাক্ত করা যাবে। কর্মকর্তার মোবাইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কবার্তা পাঠাবে প্রযুক্তি।
৬. ভেহিক্যাল স্ক্যানার বসানো হবে দুটি গেটে: একটি স্ক্যানার বসবে ক্যাটারিং গেটে, যেখান থেকে খাবারের গাড়ি এবং ফুড ওয়েস্ট বহন করে বাহির হয়। আগে এখান দিয়ে স্বর্ণ পাচারের রেকর্ড পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় স্ক্যানার বসবে ৮ নম্বর গেটে, যেখান দিয়ে সকল গাড়ি এয়ারপোর্টে প্রবেশ ও বের হয়। এখন এসব গেটে হাতে চেক করা হয়, যা কার্যকর নয়।
“ভেহিক্যাল স্ক্যানার না থাকলে পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়,” বলেন সাবেক কাস্টমস কমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম। “স্মাগলাররা কার্গো, খাবারের গাড়ি বা ফাঁকা ট্রাকে স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে। এসব গাড়ি স্ক্যান না করলে চোরাকারবার ধরা অসম্ভব।”
প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কী?
ঢাকা কাস্টমস হাউজ তাদের পরিকল্পনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, “এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য সেবাদাতা (কাস্টমস) এবং সেবাগ্রহীতা (যাত্রী, আমদানিকারক, রফতানিকারক, এজেন্ট) উভয়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং একবিংশ শতাব্দীর যোগ্য একটি কাস্টমস ব্যবস্থা গড়ে তোলা।”
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক রাগিব সামাদ বলেন, “আমি এখনো পুরো প্রস্তাবটি দেখিনি। তবে কাস্টমস যদি এমন কিছু করে, সেটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে সবারই উপকার হবে। আমরাও এর সুফল পাব।”
যাত্রীদের দুর্ভোগ কমিয়ে একটি আধুনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, তথ্যভিত্তিক ও স্বয়ংক্রিয় কাস্টমস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এ ধরনের প্রযুক্তিগত উদ্যোগ অনিবার্য। শুধু যন্ত্র বসালেই হবে না—পাশাপাশি দক্ষ জনবল, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং আন্তঃসংস্থাগত সমন্বয়ও জরুরি।
বিমানবন্দরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত তৈরি হলে, তা শুধু চোরাচালান রোধে নয়, আন্তর্জাতিক এভিয়েশন নিরাপত্তার মানদণ্ডেও বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বাংলাবার্তা/এসজে