
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ ১৬ বছরের একচ্ছত্র শাসনের অবসানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণাকে ঘিরে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার মাত্রা অনেক উঁচুতে। আজ সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে রেকর্ডকৃত ভাষণের মাধ্যমে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। এটি হবে সদ্য গঠিত সরকারের প্রথম বাজেট, যার পটভূমি জনআকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক রূপান্তরের এক অনন্য যুগসন্ধিক্ষণ।
নির্বাচিত কোনো সরকার নয়—ছাত্র আন্দোলনের ফলে ক্ষমতায় আসা একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের জন্য প্রথম বাজেট কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, এটি জনগণের আস্থা অর্জনেরও এক বড় পরীক্ষা। বিশেষ করে যখন মানুষ চরম মূল্যস্ফীতি, আয় হ্রাস, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সংকট ও ব্যাংকিং অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন এমন একটি বাজেট নিয়ে তাদের প্রত্যাশা বাস্তবের চেয়েও অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাজেট মানেই স্বস্তি চায় মানুষ
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাজেট বলতে বোঝে—নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমবে কি না, ভাড়া কমবে কি না, ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে আরও কর কাটা হবে কি না, কিংবা সংসার চালানো কতটা কষ্টকর হবে। এই ধারণার বাইরে গিয়ে বাজেটের গভীর দিকগুলো তারা সাধারণত চিন্তা করে না। এ কারণে এবার বাজেট ঘিরে সাধারণ মানুষ একটাই প্রশ্ন করছে—স্বস্তি কি ফিরবে?
চট্টগ্রামের শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম বলেন, “আমার বেতন বাড়েনি কিন্তু চাল-তেল সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। বাজেটে যদি নিত্যপণ্যের দাম কমানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকে, তবে বাজেট জনবান্ধব নয়, এটা স্রেফ হিসাবের খাতা।”
রাজধানীর কলাবাগান এলাকার গৃহিণী মাহমুদা পারভীন বলেন, “বাজেট যখন আসে তখন টিভিতে শুনি এটা ‘ঐতিহাসিক’ বা ‘ভিন্নধর্মী’। কিন্তু দোকানে গেলে দেখি পেঁয়াজ ৮০ টাকা। এবারের সরকার ভিন্ন—তাই বাজেটও যেন সত্যিকার অর্থেই ভিন্ন হয়।”
চাপ বাড়িয়েছে রাজনৈতিক বাস্তবতা
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অবশ্য ইতোমধ্যে আশ্বাস দিয়েছেন—এবারের বাজেট হবে জনবান্ধব এবং জনগণের জন্য কল্যাণমূলক। কিন্তু অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে এই বাজেটকে কেবল “আশ্বাস” দিয়ে সাজানো যথেষ্ট হবে না।
বিজনেস ইকোনমিকস ফোরামের নির্বাহী পরিচালক ড. জাফর ইকবাল চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে সরকারের হাতে রাজস্ব স্বল্পতা, চড়া মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ এবং আইএমএফের সংস্কার শর্ত—সব মিলিয়ে একধরনের ফাঁদ। এই বাস্তবতায় বাজেট জনবান্ধব রাখতে হলে রীতিমতো বাজেটের গঠন কাঠামোই পাল্টে দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এক জিনিস, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আনলে এই বাজেট ব্যর্থ হবে।”
বাজেটের কাঠামো: ছোট বাজেট, বড় প্রত্যাশা
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে।
এই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর অংশ ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরে এনবিআরের ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
রাজস্ব ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বাজেট ঘাটতির মোট অঙ্ক ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদা সুলতানা বলেন, “ঋণনির্ভর বাজেটে কর কাঠামোতে সংস্কার না এনে জনবান্ধবতা আনা কঠিন। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে করযোগ্য মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। তাই কর বাড়ানোর চাপ পড়ে ব্যবসা বা মধ্যবিত্তের ওপর।”
ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত সীমা বাড়ছে না
বেশ কয়েক বছর ধরেই বাজেট প্রস্তুতির সময় ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি উঠলেও এবারের বাজেটে তা হচ্ছে না। সরকারের অবস্থান হচ্ছে, এই সীমা অপরিবর্তিত রাখাই রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে শ্রেয়। অথচ এ সিদ্ধান্ত জনআকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
নবীন উদ্যোক্তা তানভীর রেজা বলেন, “আমার ব্যবসা এখনও লাভে আসেনি, অথচ কর দিতে হয়। করের হার বাড়লে ব্যবসা আরও কঠিন হয়ে যাবে।”
বড় কর ছাড় নয়, বরং বাছাইকৃত খাতে করোপ
সরকার রাজস্ব ঘাটতি মোকাবেলায় করপোরেট করহার বাড়াতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির ওপর কর বাড়ানো হতে পারে। তবে করপোরেট কর বাড়লে সেটা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই)-এর সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, “সরকার যদি আয় বাড়ানোর নামে করপোরেট খরচ বাড়ায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে সেটি বেকারত্বের হার বাড়াবে। এই মুহূর্তে শ্রমবাজারে আঘাত আসা মানে আর্থিক স্থিতিশীলতা হারানো।”
বাজেটে কী থাকছে?
ব্যয়ের খাত:
অনুন্নয়ন ব্যয়: ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি): ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা
মোট বাজেট ঘাটতি: ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা
রাজস্ব আয় লক্ষ্য:
এনবিআর: ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা
এনবিআরের বাইরে: ১৯ হাজার কোটি টাকা
করবহির্ভূত রাজস্ব: ৪৬ হাজার কোটি টাকা
মূদ্রাস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি:
জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা: ৫.৫%
মূদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্য: ৬.৫%
অর্থ উপদেষ্টার বাজেট উপস্থাপনা শুধু টেলিভিশনে নয়, অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে বাজেট ডকুমেন্ট সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে অনলাইনে।
সাধারণ মানুষ এবার বাজেট থেকে চায়—বাস্তব স্বস্তি। তারা চান চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় হোক, গ্যাস-পানির বিল নিয়ন্ত্রণে থাকুক, এবং বেকার তরুণেরা কাজের সুযোগ পাক। এবারের বাজেট সত্যিকার অর্থে ‘জনবান্ধব’ হলে তবেই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের আস্থা জোরদার হবে। না হলে বাজেট হবে কেবলই আরেকটি সরকারি কাগজপত্রের নামমাত্র আনুষ্ঠানিকতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ