
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বৈধ চ্যানেলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সে নতুন ইতিহাস গড়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে—এই একাদশ মাসে দেশে মোট ২৭ বিলিয়ন ৫০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার (২৭৫০ কোটি ডলার) রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২১৩৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেই তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ২৮.7 শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে প্রবাসী আয়ের মোট পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তা হয়, তবে দেশের ইতিহাসে একক অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স অর্জনের মাইলফলক স্পর্শ করবে বাংলাদেশ।
অর্থবছরের ১১তম মাস মে-তে এসেছে নতুন চমক। সদ্যসমাপ্ত মাসটিতে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯৭ কোটি মার্কিন ডলারে, যা প্রায় ৩৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে ৯ কোটি ৫৮ লাখ ডলার বা প্রায় ১১৬৯ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে একক মাসের হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ।
এর আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে। তবে মে মাসে তা অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়েছে। এদিকে দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২৫ সালের মার্চ মাসে—৩২৯ কোটি ডলার।
রেমিট্যান্সের ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী ধারা বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে মাসভিত্তিক পরিসংখ্যানেও।
জুলাই ২০২৪: ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার
আগস্ট: ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার
সেপ্টেম্বর: ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ডলার
অক্টোবর: ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার
নভেম্বর: ২২০ কোটি ডলার
ডিসেম্বর: ২৬৪ কোটি ডলার
জানুয়ারি ২০২৫: ২১৯ কোটি ডলার
ফেব্রুয়ারি: ২৫৩ কোটি ডলার
মার্চ: ৩২৯ কোটি ডলার
এপ্রিল: ২৭৫ কোটি ডলার
মে: ২৯৭ কোটি ডলার
এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রবাসী আয় মার্চের পর কিছুটা হ্রাস পেলেও এপ্রিল ও মে মাসে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মে মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহ এপ্রিলের তুলনায় ২২ কোটি ডলার বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “বর্তমানে দেশ থেকে অর্থপাচার কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। একইসাথে হুন্ডির দৌরাত্ম্যও আগের তুলনায় অনেক কমেছে। পাশাপাশি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো নিরাপদ এবং হারও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এ সব মিলিয়ে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।”
তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রেরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর মাধ্যমে দ্রুত লেনদেনের ব্যবস্থা, রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সরাসরি অবদান রাখে রেমিট্যান্স। এটি দেশের চলতি হিসাব ভারসাম্য রক্ষা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আমদানি ব্যয় নির্বাহে অন্যতম প্রধান উৎস। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি ব্যয় ও ডলারের সংকটের প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতির জন্য আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত থাকায় বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করাই হবে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। পাশাপাশি, প্রবাসীদের জন্য দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও সহজতর ব্যাংকিং চ্যানেল চালুর মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়ানো সম্ভব।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। যদি জুন মাসেও মে ও মার্চের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, তবে ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রবাহের মাইলফলক স্পর্শ করে বাংলাদেশ ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করবে—যা অর্থনীতির জন্য হবে ইতিবাচক বার্তা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে বড় সহায়ক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ