
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সোমবার (২ জুন) বিকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি এই বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। এক অনন্য রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংসদের বাইরে এই বাজেট ঘোষণা করা হলো, যা ২০০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার বাজেট ঘোষণার পর এমন একটি নজির সৃষ্টি করল।
এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।
বাজেট ঘোষণার প্রেক্ষাপট: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা স্মরণ করেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদদের। তিনি বলেন, "২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। আমাদের উপর দায়িত্ব পড়ে পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া এক চরম দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের এবং জনগণের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার।"
এই বাজেট বক্তৃতায় ড. সালেহউদ্দিন স্পষ্ট করে দেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিমালার কেন্দ্রে রয়েছে জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজস্ব খাতে স্বচ্ছতা, এবং ন্যায্যতা। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, "স্বল্প সময়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, এবং সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন খুব শীঘ্রই আমরা নিশ্চিত করতে পারব, ইনশাল্লাহ।"
যেসব পণ্যের দাম বাড়বে
এবারের বাজেটে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য, পরিষেবা ও প্রযুক্তি পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বা ভর্তুকি হ্রাসের মাধ্যমে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
-
তামাকজাত পণ্য: সিগারেটসহ অন্যান্য তামাক পণ্যে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর লক্ষ্য জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রাজস্ব আহরণ।
-
রড ও নির্মাণ সামগ্রী: নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত লোহা ও ইস্পাতের রড, স্ক্রু-নাট-বোল্ট এবং সিমেন্ট শিটের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
-
সাবান, শ্যাম্পু ও ব্লেড: দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) পুনর্বিন্যাসের কারণে দাম বাড়তে পারে।
-
দেশে তৈরি ইলেকট্রনিক পণ্য: ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওভেন, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, ব্লেন্ডার-জুসার-মিক্সার-গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি-ইস্ত্রি, লিফট, ফোর-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার যান ইত্যাদি।
-
অনলাইন ও ডিজিটাল পরিষেবা: ওটিটি কনটেন্ট এবং অনলাইন কেনাকাটার ওপর অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে ডিজিটাল ব্যবহারকারীদের ব্যয় বাড়তে পারে।
-
আবাসন খাত: ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেসে মূল্য সংযোজন কর বাড়ানো হয়েছে।
-
শিপ স্ক্র্যাপস ও সার্জিক্যাল কিটস: আমদানিনির্ভর এই খাতে শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
-
সেলফ কপি পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কোটেড পেপার: মুদ্রণ শিল্পে ব্যবহৃত এসব কাঁচামালের দামেও ঊর্ধ্বগতি আসতে পারে।
-
হেলিকপ্টার সার্ভিস ও ক্রেডিট রেটিং সার্ভিস: বিলাসবহুল পরিষেবায় কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর চেষ্টা।
-
দেশে তৈরি মোবাইল ফোন ও লিথিয়াম ব্যাটারির কিছু অংশ: স্থানীয় শিল্পে কর কাঠামো সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রণোদনার বদলে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যেসব পণ্যের দাম কমবে
অন্যদিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে শুল্ক ও কর হ্রাস করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যার ফলে সেইসব পণ্যের দাম কমে আসবে। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, ও উদীয়মান প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রণোদনা দেওয়া।
-
চিনি: দাম নাগালের মধ্যে রাখতে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।
-
স্যানিটারি ন্যাপকিন: নারীর স্বাস্থ্যসেবায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে এ খাতে কর হ্রাস।
-
আইসক্রিম: আবহাওয়া ও শিশুদের চাহিদা বিবেচনায় সীমিত শুল্ক হ্রাস।
-
ভূমি নিবন্ধন ফি: সাধারণ মানুষের জমি নিবন্ধন সহজ করতে ফি কমানো হয়েছে।
-
ক্যানসার ও ইনসুলিনের ওষুধ: স্বাস্থ্যবান্ধব বাজেট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব জীবনরক্ষাকারী ওষুধে কর মওকুফ বা হ্রাস।
-
এলএনজি ও টায়ার: জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবহণ খাতে ব্যয় কমাতে শুল্ক হ্রাস।
-
দেশে তৈরি ই-বাইক: টেকসই পরিবহণে উৎসাহ দিতে কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে।
-
মাটির পাত্র ও পেপার প্লেট: পরিবেশবান্ধব পণ্যে কর হ্রাস।
-
কম্পিউটারের বড় মনিটর (দেশি উৎপাদিত): ডিজিটাল শিক্ষায় সহায়তা দিতে এই সিদ্ধান্ত।
-
উড়োজাহাজ ভাড়া: অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্যে এ খাতে কর হ্রাস।
-
লিথিয়াম-গ্রাফিন ব্যাটারি: পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান।
সংসদের বাইরে বাজেট: নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা
দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর পর সংসদের বাইরে বাজেট ঘোষণা হলো। সর্বশেষ ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। এবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট পেশ করলেন, যিনি একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন।
বাজেটটি এখন জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর ৩০ জুন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করা হবে। তবে জনমত গ্রহণ এবং অংশীজনদের অভিমত গ্রহণের উদ্দেশ্যে পুরো জুনজুড়ে থাকবে খোলা আলোচনা।
বাজেটের আকার এবং অতীত তুলনা
নতুন বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এটি জিডিপির ১২.৬৫ শতাংশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে এই প্রথমবার বাজেটের আকার সংকুচিত করা হয়েছে বিদায়ী বাজেটের তুলনায়।
গত অর্থবছরে বাজেট দিয়েছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আওয়ামী লীগের শেষ অর্থমন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু ওই বাজেট কার্যকর হওয়ার কিছুদিন পর, ৫ আগস্ট ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
এই বাজেটকে শুধু একটি আর্থিক পরিকল্পনা হিসেবে না দেখে একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপান্তরের অংশ হিসেবেই মূল্যায়ন করছেন বিশ্লেষকরা। একদিকে যেমন কিছু পণ্যের দাম বেড়ে জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, অন্যদিকে জনকল্যাণ ও প্রযুক্তিগত প্রণোদনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টাও আছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা দিয়েছেন, বাজেটের পরদিন তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন এবং জুন মাস জুড়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। এতে বাজেট প্রক্রিয়ায় জনসম্পৃক্ততার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে পারে বলেও অনেকে আশাবাদী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ