
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করতে যাচ্ছে প্রসিকিউশন। তার পাশাপাশি এই মামলায় আরও দুজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। আগামীকাল রবিবার (১ জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে এ অভিযোগপত্র দাখিলের মধ্য দিয়ে এক ঐতিহাসিক বিচারিক অধ্যায়ের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
শনিবার (৩১ মে) সকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই তথ্য নিশ্চিত করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, “আমরা অভিযোগপত্র প্রস্তুত করেছি এবং আগামীকাল তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই মামলার বিচার দৃশ্যমান হবে, এবং বিচার কার্যক্রম এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে কেউ নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।”
এর আগে, গত ১২ মে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান মামলার তদন্ত শেষ হয় এবং তদন্ত সংস্থা তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় ১৪শ' মানুষের প্রাণহানি ঘটানো হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উঠে আসে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “আমরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, পরিকল্পনা, উসকানি এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট পাঁচটি অভিযোগে পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছি। একই ধরনের অভিযোগ এবং প্রমাণ মিলেছে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধেও।”
২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরুতে শিক্ষা-সহ সামাজিক বৈষম্যবিরোধী দাবিতে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ আন্দোলনে নামেন। এই আন্দোলনকে ঠেকাতে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহসহ সারাদেশের শহর ও জনপদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও দলীয় সমর্থকদের ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অগণিত ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে দেখা যায়, হাতে কোনো অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে চালানো হয় নির্বিচার গুলি। বহু জায়গায় লাশ না পাওয়ার অভিযোগও ওঠে, যা গণহত্যার ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
পরে ৫ আগস্ট একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হয়। একই দিন তিনি ভারতে পালিয়ে যান বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরপরই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয় এবং দেশের ভার গ্রহণ করে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আরও বলেন, “শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। ইতোমধ্যে হাসিনার নামে ট্রাইব্যুনাল থেকে আনুষ্ঠানিক নোটিশ জারি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা ছয়টি মামলার মধ্যে এ মামলাটির গুরুত্ব সর্বোচ্চ, কারণ এটি সরাসরি একটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণহত্যার বিচার।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই এমন এক বিচারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাতে ভবিষ্যতে কেউ রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে সাহস না পায়। আমাদের কাছে নিহতদের পরিবার, সারা দেশের মানুষ ও ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে।”
তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনা ছাড়া আরও দুইজন অভিযুক্তের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। আসাদুজ্জামান খান কামাল ছিলেন তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি নিরাপত্তা বাহিনীর অপারেশন ও মোতায়েন সংক্রান্ত দায়িত্বে ছিলেন। আর চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ছিলেন পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তদন্ত সংস্থার মতে, উভয়েই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে ওই সময় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তারা গুলি চালানোর অনুমতি দিয়েছেন, অপারেশন প্ল্যান অনুমোদন করেছেন এবং পরবর্তীতে অপরাধ গোপনে রাখারও চেষ্টা করেছেন।
গণহত্যায় নিহতদের পরিবার এবং নাগরিক সমাজ এ মামলার বিচারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই গণহত্যা ছিল আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নির্মম ও বীভৎস ঘটনা। তারা ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার চেয়ে আসছে।
নিহতদের পরিবার থেকে একজন জানান, “আমার ভাইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সেদিন গুলি করে ওকে মেরে ফেলা হয়। আমরা এই বিচার দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছি। এখন অন্তত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় এসেছে।”
আগামীকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের মধ্য দিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত বিচারিক প্রক্রিয়ার নতুন ধাপ শুরু হচ্ছে। দেশজুড়ে এই মামলার প্রতি জনস্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগ এখন তুঙ্গে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে—এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিচার ব্যবস্থার জন্যও এক নজিরবিহীন ঘটনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ