
ছবি: সংগৃহীত
স্বর্ণ—যা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের প্রাচুর্য, সম্মান ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে—তা আজকের দিনে এসেও বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তায় এক অবিচ্ছেদ্য আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের মে মাসজুড়ে বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজার ছিল রীতিমতো টালমাটাল। স্বর্ণের দাম উঠেছে-নেমেছে নাটকীয়ভাবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর। স্বর্ণের এমন দামের হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন যেন গোটা বাজারে অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগের আবহ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যানুসারে, শুধুমাত্র মে মাসেই স্বর্ণের দাম পরিবর্তন বা সমন্বয় করা হয়েছে ১০ বার, যার মধ্যে ৫ বার দাম বেড়েছে এবং বাকি ৫ বার কমানো হয়েছে। পুরো মাসজুড়ে এমন দফায় দফায় মূল্য সমন্বয়ের ফলে বাজারে এক ধরনের নড়বড়ে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষের সিদ্ধান্তে।
মাসের শুরুতেই স্বর্ণের দাম কমে যায়। ৩ মে তারিখে এক লাফে ভরিপ্রতি ৩ হাজার ৫৭০ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৭৬ টাকা। তবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে, ৫ মে দাম আবার বাড়ানো হয় ২ হাজার ৩১০ টাকা।
এর ঠিক একদিন পর, ৬ মে আবারও বড় অঙ্কে বাড়ে দাম—ভরিপ্রতি ৩ হাজার ৬৬২ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯৪৮ টাকা, যা ছিল মে মাসের সর্বোচ্চ মূল্য।
তবে বাজার এই উচ্চতায় স্থির থাকেনি। ৮, ১০ ও ১২ মে তারিখে তিন ধাপে দাম কমিয়ে মোট ৭ হাজার ৩২৫ টাকা হ্রাস করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৩ টাকায়।
এরপর ১৩ মে ফের বাড়ানো হয় ১ হাজার ৫৬৩ টাকা, যার ফলে দাম হয় ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৮৬ টাকা। কিন্তু স্থিতিশীলতা আসেনি। ১৫ মে আবারও ভরিতে ৩ হাজার ৪৫২ টাকা কমিয়ে স্বর্ণের দাম নামিয়ে আনা হয় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭৩৪ টাকায়।
এরপরের দুই ধাপে—১৭ ও ২১ মে—ক্রমাগত দুইবার দাম বাড়ানো হয় যথাক্রমে ১ হাজার ৩৬৪ টাকা এবং ২ হাজার ৮২৩ টাকা। সর্বশেষ এই বাড়ানোর ফলে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯২১ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত চলতি বছরের মধ্যে অন্যতম উচ্চমূল্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বর্ণের দামের এই ক্রমাগত ওঠানামার মূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও সরবরাহে অসঙ্গতি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক মুদ্রানীতির কড়াকড়ি ও ডলারের দামের ওঠানামা।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম এককভাবে কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনার ওপর নির্ভর করে না। বরং সেখানে প্রভাব ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের সুদহার, ডলার ইনডেক্স, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ কিংবা ইউরোপের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দামে বড় ধরনের পরিবর্তন হলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের বাজারেও সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটে। তাই বাজুস আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বিবেচনায় নিয়ে দেশীয় বাজারে দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান চেজ সম্প্রতি এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের মূল্য ২০২৬ সালের মধ্যেই আউন্সপ্রতি ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের বিশ্লেষণে বলা হয়, চলতি বছর প্রতি প্রান্তিকে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের গড় চাহিদা থাকতে পারে ৭১০ টন, যা দামের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রাখার পক্ষে সহায়ক।
২০২৫ সালের শেষ নাগাদ স্বর্ণের গড় দাম হতে পারে ৩ হাজার ৬৭৫ ডলার প্রতি আউন্স, তবে বাজারে পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এটি আরও আগেই ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পূর্বাভাসে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে স্বর্ণকে এক ‘সেফ হেভেন’ বা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আরও বেশি বেছে নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বর্ণে বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরেই একটি নির্ভরযোগ্য পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। বিশেষ করে অনিশ্চয়তাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটকালীন সময়ে স্বর্ণ অনেক বিনিয়োগকারীর কাছে আশ্রয়ের মতো মনে হয়।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, স্বর্ণের বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রমাগত দামের ওঠানামা বিবেচনায় নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি লাভের সম্ভাবনা থাকলেও স্বল্পমেয়াদে বাজারের এমন টালমাটাল অবস্থায় দ্রুত লাভবান হওয়ার আশায় বিনিয়োগ করলে লোকসানের ঝুঁকি থাকেই।
মে মাসের স্বর্ণের দামের পর্যালোচনা বলছে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন সরাসরি পড়ছে বাংলাদেশি বাজারে। বাজুসের ঘন ঘন মূল্য সমন্বয় এবং বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে দেশে স্বর্ণের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি যেমন সতর্ক হওয়ার সময়, তেমনি সম্ভাবনাও নিহিত রয়েছে যদি কেউ দীর্ঘমেয়াদে বাজার বিশ্লেষণ করে এগিয়ে যেতে পারেন। এক কথায়, স্বর্ণের বাজার এখন আবেগ নয়, বিশ্লেষণ দিয়ে বুঝতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ