
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অস্থায়ী সরকারের আওতায় পরিচালিত উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে অনুমোদন পেল ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এই বিশাল বাজেট আগামী এক বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক ব্যয়ের রূপরেখা নির্ধারণ করবে।
আজ সোমবার (২ জুন) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বিশেষ বৈঠকে বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টা চলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
উপদেষ্টা পরিষদের সম্মতিক্রমে অনুমোদিত এ বাজেটের আকার ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় বাজেট। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং কাঠামোগত সংস্কারে গতি আনার লক্ষ্যে সাজানো হয়েছে এবারের বাজেট কাঠামো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাজেট শুধু অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি একটি তত্ত্বাবধায়ক-ধাঁচের সরকারের মাধ্যমে অনুমোদিত।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বাজেট অনুমোদনের পরপরই অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে গিয়ে বাজেট বক্তৃতা রেকর্ড করেন। বিকেল ৩টা থেকে বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে এই রেকর্ডকৃত বাজেট ভাষণ সম্প্রচারিত হবে।
জনগণের সর্বস্তরে বাজেট তথ্য পৌঁছে দিতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং এফএম ও অনলাইন রেডিও স্টেশনগুলোকে বিটিভি থেকে সরাসরি ফিড নিয়ে বাজেট বক্তৃতা সম্প্রচারের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই উদ্যোগকে বাজেটের ‘গণসম্পৃক্ততা’ নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে নীতিনির্ধারণী মহল।
অর্থনৈতিক বাজেট অনুমোদনের পাশাপাশি আজকের দিনটি রাজনৈতিক অর্থেও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম দফার আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব মতানৈক্য রয়ে গিয়েছিল, সেগুলো দূর করতে আজ থেকেই শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় দফার সংলাপ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই সংলাপে নেতৃত্ব দেবেন কমিশনের চেয়ারম্যান ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু হবে এই সংলাপের দ্বিতীয় পর্যায়।
এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ মে পর্যন্ত চলমান প্রথম দফার আলোচনায় মোট ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংলাপের এই প্রক্রিয়া গঠনমূলক হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থেকেই গিয়েছিল।
দ্বিতীয় দফার আলোচনায় সেসব পার্থক্য দূর করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক রূপরেখা এবং সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রক্রিয়াকে চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।
বাজেট ও সংলাপের পাশাপাশি আজকের দিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলো—গঠিত পাঁচটি রাষ্ট্রীয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু।
এই সংস্কার কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামো ও কার্যপ্রণালী ঢেলে সাজানোর জন্য।
প্রথম দফায় সংলাপের ভিত্তিতে কমিশনগুলো ইতোমধ্যে খসড়া সুপারিশ জমা দিয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংলাপের সমান্তরালে এসব সুপারিশ পর্যালোচনা এবং চূড়ান্তকরণের কাজ চলবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, জুলাইয়ের মধ্যেই এসব সুপারিশ পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা হতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্যমতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে যে বিষয়গুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হলো:
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব
রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তিনির্ভরতা
পাবলিক বিনিয়োগের কার্যকারিতা বৃদ্ধি
ব্যাংক খাত সংস্কারে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ
রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনা এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ধরে রাখা
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এমন একটি সুপরিকল্পিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট দেশে স্থিতিশীলতা এবং আস্থার বার্তা দিতে পারে। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই হবে বাজেট সফলতার মূল চাবিকাঠি।
দেশ এখন এক নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ প্রক্রিয়া একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই রূপরেখা তৈরি করতে আজকের সিদ্ধান্তগুলো গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ