
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শতবর্ষব্যাপী ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে 'বিশেষ মর্যাদা' দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এর শিক্ষকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রগঠনে অনবদ্য অবদান, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় পথপ্রদর্শক ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে এই দাবি পেশ করা হয়েছে। রোববার (১ জুন) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন শিক্ষকেরা, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে তাকে ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
৮৩টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের স্বাক্ষরিত এই স্মারকলিপিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষব্যাপী সংগ্রামী ইতিহাস ও অর্জনের বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত—দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পালাবদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মূল চালিকাশক্তি। এ প্রতিষ্ঠান কেবল শিক্ষা নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনার প্রেরণাস্থল হিসেবে কাজ করে আসছে।”
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, “বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে যে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অন্যতম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাজপথে যেমন আন্দোলনের নেতা ছিলেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করেও জাতির জন্য আত্মত্যাগ করেছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্মারকলিপিতে জাতি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়টির অব্যাহত অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এক শতাব্দী ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি মানবসম্পদ তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে প্রশাসন, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কূটনীতি, শিক্ষানীতি ও ব্যবসায়িক নেতৃত্বে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান।”
তাঁরা বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ উন্মুক্ত রেখেছে। এই বহুত্ববাদী নীতির মাধ্যমে শিক্ষার সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলকতা নিশ্চিত করছে, যা একটি টেকসই জাতির ভিত্তি গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
স্মারকলিপিতে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। তারা বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষ আর্থিক-প্রশাসনিক সুবিধা দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এই ধরনের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন এখন সময়ের দাবি।”
তাঁরা আরও উল্লেখ করেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে গুণগতভাবে আরও এগিয়ে নিতে হলে একে একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এর ফলে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাই একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে।”
স্মারকলিপি প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী সংগঠন ‘সাদা দল’-এর নেতৃবৃন্দ। দলটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা নয়, রাজনীতির ক্ষেত্রেও বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের দাবি, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ প্রতিষ্ঠানকে তার উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হোক।”
সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, “ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণআন্দোলন এবং সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অগ্রণী। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় এখনো কোনো বিশেষ মর্যাদা পায়নি, যা দুঃখজনক।”
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ কাউসার, স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মাহবুবা সুলতানা, শামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল আজিম এবং উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ প্রমুখ।
তাঁরা প্রত্যেকেই স্মারকলিপিতে উল্লিখিত দাবির প্রতি একমত পোষণ করেন এবং বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মূল্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রের উচিত যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান স্মারকলিপিটি গ্রহণ করে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং বলেন, “আপনাদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। আমি বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করব।”
তিনি আরও বলেন, “বিশেষ মর্যাদা কেবল একটি তকমা নয়, এটি একটি নীতিগত স্বীকৃতি যা গবেষণা, শিক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ ও নীতিনির্ধারণে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এমন স্বীকৃতির দাবিদার।”
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে পেশ করা এই দাবি কেবল একটি প্রশাসনিক অনুরোধ নয়, বরং একটি প্রজন্মব্যাপী ঐতিহাসিক অবদান ও জাতি গঠনে অংশগ্রহণের ন্যায্য প্রতিদান—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্র কত দ্রুত এবং কীভাবে এই দাবির প্রতি প্রতিক্রিয়া জানায়। কারণ, এই দাবির বাস্তবায়ন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও হতে পারে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ