
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ ১৪ বছরের অপেক্ষা ও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। মঙ্গলবার (২৭ মে) সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক নির্দেশনা দেন, যা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হওয়া অসংখ্য পরিবারের জন্য এক বিজয়ের বার্তা।
চাকরিচ্যুত এই কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের চাকরি ফিরে পেতে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। এর আগে তাদের বরখাস্তের বিষয়ে উচ্চ আদালত আদেশ বহাল রাখলেও পরে রিভিউ পিটিশনের ভিত্তিতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায় দেন—যে ৯৮৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ২০১১ সালে বরখাস্ত হয়েছিলেন, তারা আবারও চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন।
এই রায় শুধু একটি আইনি জয় নয়, বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল বলেও অনেকেই মনে করছেন।
২০০৩ ও ২০০৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্মারক ও নিয়ম অনুসরণ করে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ৯৮৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সহকারী রেজিস্ট্রার, কেয়ারটেকার, হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারীসহ বিভিন্ন পদে নিযুক্ত শত শত কর্মী। তবে এই নিয়োগের ৯ বছর পর ২০১১ সালে একটি আলোচিত আদালত রায়ের ভিত্তিতে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়।
রায়টি আসে একটি বিতর্কিত রিট মামলার প্রেক্ষিতে, যা ২০০৪ সালে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া দায়ের করেন। তিনি নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। যদিও ২০০৬ সালে হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে, এরপর গাজীপুর-১ আসনের তৎকালীন এমপি আকম মোজাম্মেল হক ২০১০ সালে রিভিউ আবেদন করে মামলাটি পুনরায় সক্রিয় করেন। এই রিভিউয়ের ভিত্তিতেই ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে চাকরিচ্যুতি ঘটে।
তবে এই বরখাস্তের সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। অভিযোগ রয়েছে, কিছু দুর্নীতিপরায়ণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল মিলে আদালতে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করান।
চাকরি হারানোর পর অনেকেই চরম আর্থিক সংকটে পড়ে যান। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া ও সরকারি উদাসীনতায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। কেউ কেউ চিকিৎসার অভাবে মারা যান, অনেকে পরিবার নিয়ে পথে বসেন। বঞ্চনার দীর্ঘ এ অধ্যায় নিঃসন্দেহে ছিল এক ধরনের প্রশাসনিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়, যখন ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, তখন চাকরি ফিরে পেতে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা সংগঠিত হয়ে আবারও আন্দোলন শুরু করেন। রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব ও শাহবাগে একাধিক মানববন্ধন ও গণঅনশন অনুষ্ঠিত হয়।
বদলে যাওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের দাবির পক্ষে অবস্থান নেয়। ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে চাকরি হারানো কর্মীদের পুনর্বহালের লক্ষ্যে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় মামলা পুনরুজ্জীবিত হয় এবং আজ তারই চূড়ান্ত রায় এসেছে।
এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন চাকরিচ্যুত কর্মীরা ও তাদের পরিবার। অনেকেই বলেন, “আমরা অবশেষে ন্যায়বিচার পেলাম। যারা আমাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছিল, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।”
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক সিনিয়র অফিসার বলেন, “দীর্ঘদিনের অবিচারের অবসান হলো আজ। এই আদেশ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল।”
ভবিষ্যৎ করণীয়
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতের রায় বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। পুনর্বহালকৃত কর্মীদের জটিলতা নিরসনে একটি বিশেষ সেল গঠন করা হতে পারে, যারা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ, পদায়ন এবং অবসরের হিসাব নির্ধারণে সহায়তা করবে।
এই রায়ের ফলে যে বার্তা স্পষ্ট হয়েছে তা হলো—রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অন্যায়ভাবে চাকরি হারালে, শেষ পর্যন্ত আইনের কাছে সুবিচার পাওয়া সম্ভব। এটি শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্যই একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ