
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় অবস্থিত সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি ঘোষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই সাত কলেজের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান করবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ইউজিসি সাত কলেজের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সাময়িক প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা কলেজের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক একেএম ইলিয়াসকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে প্রশাসক হিসেবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে তাঁকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করেছে।
রোববার (১৯ মে) বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, “নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সাত কলেজের সার্বিক প্রশাসন ইউজিসির অধীনে পরিচালিত হবে। এ সময়ের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে, যার মূল নেতৃত্বে থাকবেন অধ্যাপক একেএম ইলিয়াস।”
অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন আরও জানান, সাত কলেজের এই প্রশাসনিক কাঠামোর প্রধান কার্যালয় থাকবে ঢাকা কলেজে। অচিরেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশ করবে, যেখানে প্রশাসনের কাঠামো, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে।
উল্লেখ্য, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ—এই সাতটি কলেজকে ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। তবে সেই সময় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতা, পরীক্ষার সময়সূচী, সেশনজট ও সার্বিক শিক্ষার মান নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছিল।
সরকার এ সমস্যা সমাধানে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে সম্প্রতি একটি একক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো গঠনের উদ্যোগ নেয়। ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি ‘হাইব্রিড মডেল’-এ পরিচালিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে এবং বাকি ৬০ শতাংশ সরাসরি শ্রেণিকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কাঠামো এমনভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে যাতে প্রতিটি কলেজ আলাদা আলাদা অনুষদ ক্যাম্পাস হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন, সরকারি তিতুমীর কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, অন্যদিকে ঢাকা কলেজে থাকবে বিজ্ঞান অনুষদ—এমন বিভাজন করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার চিন্তাভাবনা চলছে।
তবে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে বিস্তারিত আইনি অনুমোদন, একটি পূর্ণাঙ্গ আইন, ভৌত অবকাঠামো, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষক নিয়োগসহ নানাবিধ প্রস্তুতি। এসব কাজ সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লাগবে বলেই প্রশাসন মনে করছে। তাই এ সময়কালটিতে ইউজিসি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন ম্যানেজমেন্ট কমিটি কার্যক্রম তদারকি করবে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা চাইছেন দ্রুততার সঙ্গে এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হোক। গতকাল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবির প্রস্তাব তুলে ধরেন। তাঁরা অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক কাঠামো ও গেজেট প্রকাশের দাবি জানান এবং ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। দাবি পূরণ না হলে কঠোর কর্মসূচি—যেমন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ঘেরাও—নিতে বাধ্য হবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
তাঁরা আরও বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা ও প্রশাসনিক জটিলতা কাটাতে একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। নয়তো সেশনজট, পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়া, ফল প্রকাশে দেরি—এই সংকটগুলো কখনোই শেষ হবে না।
এই সাতটি কলেজে বর্তমানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। দীর্ঘদিন ধরেই এই শিক্ষার্থীরা স্বচ্ছ, নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর থেকে পরীক্ষার সময়সূচী, ফলাফল ও একাডেমিক ক্যালেন্ডারে অনিয়ম নিয়ে প্রায়ই তারা আন্দোলনে নেমেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের ঘোষণাকে শিক্ষার্থীরা সাধুবাদ জানালেও, দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে তা আরও হতাশার জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
অন্যদিকে ইউজিসি ও প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, কাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের প্রক্রিয়া সহজ নয়—এতে সময় লাগবে, কিন্তু তা হবে সুষ্ঠুভাবে এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই।
বর্তমানে ইউজিসির অধীনে পরিচালিত এই সাত কলেজের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে যদি কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকে এবং সঠিক পরিকল্পনায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়, তাহলে দেশের ইতিহাসে এটি হতে পারে একটি যুগান্তকারী শিক্ষাপদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ