
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ তিন দিনের টানা আন্দোলনের পর অবশেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস পেলে শুক্রবার (১৭ মে) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কাকরাইল মোড় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। আগামীকাল শনিবার (১৮ মে) থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে।
এই ঘোষণাটি দেন জবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছউদ্দীন। একই সময়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরাও অবস্থান ত্যাগ করে ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে শুরু করেন।
এর আগে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ জানান, সরকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থাপিত প্রধান দাবিগুলো মেনে নিয়েছে। তার ভাষায়, “শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলোর বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার আন্তরিকভাবে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিচ্ছে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত কয়েক বছর ধরেই আবাসন সংকট, পর্যাপ্ত বরাদ্দ, এবং দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। চলতি বছর সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাবিত বাজেট দেয়, সেখানে জবির বরাদ্দ কমে যাওয়ার তথ্য সামনে আসার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ চরমে ওঠে।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা ১৫ মে (বুধবার) থেকে কাকরাইল মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন।
তাদের প্রধান তিনটি দাবি ছিল:
আবাসন সুবিধা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ‘আবাসন বৃত্তি’ চালু করা।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট থেকে কোনো ধরনের কাটছাঁট না করে তা অনুমোদন করা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রকল্প পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
দাবি আদায়ে শুক্রবার (১৭ মে) বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে শিক্ষার্থীরা অনশনে বসেন। বিভিন্ন বিভাগের শত শত শিক্ষার্থী ভাগ হয়ে গ্রুপে গ্রুপে অনশনে অংশ নেন। এ সময় তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকরাও।
এর আগে বুধবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় কাকরাইল মোড়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ, যার ফলে অন্তত একাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
এই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সেখানেই অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান ত্যাগ করবেন না বলে জানান।
লাঠিচার্জের প্রতিবাদে পুলিশি হামলার বিচার দাবিও তখন থেকেই আন্দোলনের নতুন অংশ হয়ে ওঠে।
বুধবার রাতেই তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে কাকরাইল যান। তবে সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের একাংশ তার দিকে পানির বোতল ছুঁড়ে মারেন, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। সরকারপক্ষের কেউ সেদিন আর সামনে এগিয়ে আসেননি।
এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার (১৬ মে) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিকেল ৪টায় শিক্ষকরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ‘শাটডাউন’ করার ঘোষণা দেন।
দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শিক্ষামন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা পর্দার আড়ালে উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি মানার প্রতিশ্রুতি আসে এবং ইউজিসি চেয়ারম্যান তা জনসমক্ষে জানান।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাতে আস্থা রেখে রাতেই আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।
আন্দোলনকারীদের অন্যতম সংগঠক বলেন, “আমরা কোনদিনই সহিংসতা চাইনি। আমাদের দাবি ছিল যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবসম্মত। সরকার আমাদের কথা শুনেছে—এটাই আমাদের আন্দোলনের সফলতা।”
আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর ধরে অবহেলার শিকার। আমরা চাই আমাদের প্রতিষ্ঠান দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুযোগ-সুবিধা পাক।”
এই আন্দোলন একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার গভীরতা তুলে ধরেছে, তেমনি সরকারের দ্রুত সাড়া ও শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল মনোভাবও প্রশংসার দাবিদার। এখন দেখার বিষয়, সরকারের প্রতিশ্রুতি কবে এবং কীভাবে বাস্তবায়ন হয়। বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরের প্রতিক্রিয়া দেখার আশঙ্কা রয়েছে—এমন মন্তব্যও করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষানবিশ ও শিক্ষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ