
ছবি: সংগৃহীত
মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামের আট বছরের শিশু আছিয়া আক্তারের ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের একমাত্র দায়ী হিসেবে হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তবে একই মামলায় অভিযুক্ত তার স্ত্রী জাহেদা বেগম এবং দুই পুত্র সজীব শেখ ও রাতুল শেখকে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (১৭ মে) সকালে মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বলা হয়, অভিযুক্ত হিটু শেখের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তার দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি (মেডিকেল অ্যাভিডেন্স), ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ২৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি—সব কিছু বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অপরাধটি হিটু শেখ একাই সংঘটিত করেছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক বা পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যার ফলে আদালত তাদের খালাস প্রদান করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, “আসামির স্বীকারোক্তি এবং চিকিৎসা-সাক্ষ্য ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে বিচারক নিখুঁত ও ন্যায়ভিত্তিক রায় দিয়েছেন। এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে আমরা মনে করি।”
অপরাধ সংঘটিত হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যেই রায় ঘোষণা হওয়া এই মামলাটি দেশের দ্রুততম বিচার প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাগুরা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রফিকুল ইসলাম ১৩ এপ্রিল মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। এরপর ২৩ এপ্রিল আদালত অভিযোগ গঠন করেন এবং ২৭ এপ্রিল শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। মাত্র ১৪ কার্যদিবসে ছুটির দিন বাদে টানা বিচারকার্য পরিচালনার মাধ্যমে মামলার রায় দেওয়া হয়।
৮ বছরের শিশু আছিয়া আক্তার তার বোনের শ্বশুরবাড়ি—মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল গত ৬ মার্চ। সেখানেই ঘরের এক কোণে তার বিবস্ত্র, রক্তাক্ত ও অচেতন দেহ উদ্ধার করা হয়।
মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং অবশেষে ঢাকা সিএমএইচ-এ স্থানান্তর করা হয়।
সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ মার্চ আছিয়া মারা যায়। তার মৃত্যুর পর দেশব্যাপী শিশু সুরক্ষা ও নারী নির্যাতন বিরোধী সচেতন মহলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত হিটু শেখ প্রতিবেশী ছিলেন এবং পূর্বপরিকল্পিতভাবে একা এই জঘন্য ঘটনা ঘটান। ঘটনার দিন সে বাড়ির অন্যদের অনুপস্থিতির সুযোগে আছিয়াকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এবং পরে প্রাণঘাতী আঘাত করে।
এই রায়ের পর শিশু অধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠন সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের মহাসচিব আবু সালেহ বলেন, “এই রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধ কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। তবে দ্রুত রায় হলেও কার্যকর প্রক্রিয়াটি যেন ত্বরান্বিত হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।”
আছিয়ার পরিবার রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। আছিয়ার মা বলেন, “আমার মেয়ে ফিরে আসবে না। কিন্তু আমি খুশি যে ওর খুনির বিচার হয়েছে। আমি চাই এই রায় দ্রুত কার্যকর হোক।”
এদিকে গ্রামে আছিয়ার মৃত্যুর পর থেকে শোকের ছায়া কাটেনি। মামলার রায় ঘোষণার পর এলাকাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে।
হিটু শেখের এই দণ্ডপ্রাপ্তির মাধ্যমে একটি ভয়াবহ শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচারিক সমাপ্তি ঘটলেও মানবিক ও সামাজিক বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষাব্যবস্থায় গভীর প্রশ্ন তোলে। দ্রুত বিচার যেমন ইতিবাচক, তেমনি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা, শিক্ষা এবং নজরদারি আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই রায় শুধু একজন অপরাধীর সাজা নয়, বরং একটি সমাজের বিবেক জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে—যদি তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ