
ছবি: সংগৃহীত
দেশের মাইক্রোফাইন্যান্স খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, শনিবার (আজ) সকালে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, মাইক্রোক্রেডিট খাতকে আরও কার্যকর ও জনমুখী করতে হলে এর জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন জরুরি। তার ভাষায়, "মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের জন্য আলাদা আইন করতে হবে, এটা যেন একটা নতুন ব্যাংক হয়।"
ড. ইউনূস বলেন, “আমরা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে মাইক্রোক্রেডিটকে শুধু ঋণ হিসেবে দেখলে হবে না। এর সম্ভাবনা অনেক গভীর, অনেক বিস্তৃত। তাই এর জন্য আলাদা কাঠামো ও আইনগত ভিত্তি থাকা প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন, মাইক্রোফাইন্যান্স রেগুলেটরি অথরিটিই এ উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও নীতিমালায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তারা একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের রূপরেখা দাঁড় করাতে পারে।
ড. ইউনূস বলেন, “মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে এখন নতুন চিন্তা, নতুন কাঠামো দরকার।” উল্লেখ্য, মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থাকে একটি সামাজিক ব্যবসার রূপ দিয়ে তিনি বিশ্বে এর পথ দেখিয়েছেন। তার হাতে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক মডেল বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, "শুরুতে মানুষ এটাকে শুধু দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ মনে করত। এখন এটি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে চলে এসেছে। ফলে এটি আর শুধু এনজিও ভিত্তিক কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না।"
তার মতে, দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মাইক্রোক্রেডিট বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। নারী ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গঠনে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আনতে এর অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাই এখন সময় এসেছে এই পুরো ব্যবস্থাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর, যাতে এর পরিচালনা, হিসাবনিকাশ, তদারকি ও গ্রাহক সুরক্ষার বিষয়গুলো আরও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিচালিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের প্রচলিত ব্যাংকগুলো কখনোই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দরজায় পৌঁছাতে পারে না। মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক সেই কাজটাই করে। কিন্তু যখন এই ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করে একটি এনজিও কাঠামোয়, তখন তাদের আইনগত সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। এর ফলে অনেক সময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্ন ওঠে। আলাদা একটি ব্যাংক আইন থাকলে, যেটা কেবল মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তৈরি হবে, তখন এই সমস্যাগুলো দূর হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ব্যাংক হতে হবে সাধারণ ব্যাংকের মতো নয়, আবার এনজিওর মতোও নয়। এটি হবে এমন একটি ব্যাংক, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন, তাদের আয়ক্ষমতা, তাদের সঞ্চয় ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে একটি সম্পূর্ণ নতুন কাঠামো গড়ে তোলা হবে।”
উল্লেখ্য, আজকের অনুষ্ঠানে দেশের মাইক্রোফাইন্যান্স খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধন করা হয় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নিজস্ব ভবন। এটি দেশের মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম তদারকির মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। নতুন ভবনের উদ্বোধনের মাধ্যমে সংস্থাটির প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও বিস্তৃত ও দক্ষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা বলেন, বর্তমানে দেশে ৭০০টিরও বেশি মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে লাখ লাখ পরিবার আর্থিক সেবার আওতায় এসেছে। তবে এসব কার্যক্রম যেন সুসংগঠিত, কার্যকর এবং জবাবদিহিমূলক হয়, সেজন্য নতুন আইন ও কাঠামো সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। মাইক্রোক্রেডিট খাতের সম্ভাবনা বাস্তবায়নে এটি যদি পৃথক ব্যাংক হিসেবে গড়ে ওঠে এবং একটি শক্তিশালী আইনগত কাঠামোতে চলে, তাহলে দেশের গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগণের জন্য এটি হতে পারে একটি আর্থিক মুক্তির পথ। মাইক্রোক্রেডিটকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় যুক্ত করতে এই পদক্ষেপ একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ