
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার দাবিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এর আওতাধীন কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগে আজ শনিবার (১৭ মে ২০২৫) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত টানা পাঁচ ঘণ্টা কলম বিরতি পালন করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ডাকে এই কর্মসূচিতে দেশের সব স্তরের রাজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনকারীরা এনবিআর বিলুপ্ত করে প্রণীত অধ্যাদেশ বাতিল করে যুগোপযোগী ও টেকসই রাজস্ব সংস্কার দাবি করছেন, যা সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত নয় বরং অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন।
রাজস্ব সংস্কারের দাবিতে চলমান এই আন্দোলনের অন্যতম দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব নীতি ও প্রশাসনকে পৃথক করা, এনবিআর বিলুপ্ত করে প্রণীত অগণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ বাতিল এবং প্রকৃত অংশীজনদের মতামত গ্রহণ করে সংস্কারের নতুন রূপরেখা প্রণয়ন। ঐক্য পরিষদের মতে, সরকারের বর্তমান সংস্কার উদ্যোগটি সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের উপেক্ষা করে প্রণীত হওয়ায় তা রাজস্ব ব্যবস্থায় চরম অস্থিরতা ও কর্মপরিবেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে।
আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, যে সংস্কার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে তা কোন রকম পরামর্শ, আলোচনার সুযোগ ছাড়াই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যারা রাজস্ব আদায়ে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের মতামতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আজকের কলম বিরতিতে অংশগ্রহণকারী সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ এক বিবৃতিতে বলেন, “দেশের স্বার্থে রাজস্ব ব্যবস্থায় একটি বাস্তবমুখী, টেকসই এবং অংশগ্রহণমূলক সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজন। এনবিআরের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি করে আসছেন। এই আন্দোলন কোনো গোষ্ঠীস্বার্থ নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং জাতীয় দাবি।”
ঐক্য পরিষদ মিডিয়া, সাংবাদিক সমাজ এবং বিভিন্ন সুশীল সংগঠন ও স্টেকহোল্ডারদের অকুন্ঠ সমর্থনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছে, “আমরা তাঁদের সহযোগিতাকে দেশের রাজস্ব সংস্কারে জনসম্পৃক্ততার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে দেখছি।”
এদিনের কর্মবিরতিতে করদাতা ও সেবাগ্রহীতাদের কিছুটা অসুবিধা হলেও ঐক্য পরিষদ তাঁদের প্রতি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে পরিষদের মতে, “এই সাময়িক ভোগান্তির বিনিময়ে যে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই সংস্কার হবে, তা দেশের রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য সুফল বয়ে আনবে। তাছাড়া, আমাদের যৌক্তিক দাবি পূরণ হলে আমরা অফিস সময়ের বাইরে অতিরিক্ত সময় দিয়ে অনিষ্পন্ন কার্যক্রম সমাপ্ত করব।”
বিবৃতিতে ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে, তাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক এবং সাংগঠনিকভাবে পরিচালিত। তবে গতকাল (১৬ মে) কিছু বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীর মাধ্যমে আন্দোলনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে চেষ্টা হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।
এছাড়া আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, বিসিএস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশনের অনির্বাচিত নির্বাহী কমিটিকে সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা অবৈধ ও বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন এবং বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনেরও প্রায় সকল নির্বাহী সদস্য পদত্যাগ করায় সেটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাই এই দুই কমিটির পক্ষ থেকে কেউ কোনো বিবৃতি দিলে তা ব্যক্তিগত বিবৃতি হিসেবে গণ্য হবে বলে পরিষদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে।
আজকের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় আগামীকাল রবিবার (১৮ মে) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার কলম বিরতি পালিত হবে। তবে পূর্বের মতো আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, রপ্তানি কার্যক্রম এবং বাজেট প্রণয়ন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড এই কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। দুপুর ১২টায় একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
পরিষদের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, “আমরা আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থার সমাধান চাই। আমাদের আন্দোলন কখনোই সরকারের বিরুদ্ধে নয়; বরং একটি অংশগ্রহণমূলক এবং যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে। আমরা আশাবাদী, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সুদৃষ্টি ও সদিচ্ছার মাধ্যমে সরকার আমাদের সাথে আলোচনা করবে। আলোচনার দরজা আমাদের পক্ষ থেকে সবসময়ই খোলা ছিল, আছে এবং থাকবে।”
জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় খাতে বাস্তবভিত্তিক সংস্কার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের এই ঐক্যবদ্ধ ও ধারাবাহিক আন্দোলন সরকারকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ একটি গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের দাবি জানিয়ে যে নীতিগত অবস্থান নিয়েছে, তা এখন জাতীয় পর্যায়ের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। দেখার বিষয়, সরকার এই দাবিকে কীভাবে মূল্যায়ন করে এবং কত দ্রুত আলোচনার টেবিলে বসে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটায়।
বাংলাবার্তা/এসজে