
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য উন্নয়ন বাজেটের (Annual Development Programme – ADP) খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশন। এবারের বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে, যা অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছরের ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার এডিপি থেকে কমিয়ে নতুন খসড়ায় বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা—অর্থাৎ কমেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে যদি সংশোধিত এডিপি (২ লাখ ১৬ হাজার কোটি) বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এবারের বরাদ্দ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
নতুন বাজেটের মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হবে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এই দুই অংশে মিলিয়ে মূল এডিপির আকার দাঁড়াল ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন থেকে আরও ৮ হাজার ৫৯৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যা মিলিয়ে মোট এডিপির আকার দাঁড়াবে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
এই খসড়া বাজেটটি আগামী রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (NEC) সভায় উপস্থাপন করা হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নতুন এডিপিতে বরাদ্দের প্রায় ৭০ শতাংশই (সুনির্দিষ্টভাবে ৬৯.৯৩%) যাচ্ছে পাঁচটি প্রধান খাতে: পরিবহণ ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা।
পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫৮,৯৭৩ কোটি টাকা (২৫.৬৪%)
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ৩২,৩৯২ কোটি টাকা (১৪.৮%)
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২৮,৫৫৭ কোটি টাকা (১২.৪২%)
গৃহায়ন ও নগর সুবিধা খাতে বরাদ্দ ২২,৭৭৬ কোটি টাকা (৯.৯০%)
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১৮,১৪৮ কোটি টাকা (৭.৮৯%)
মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ—৩৬,০৯৮ কোটি টাকা (১৬.৪৭%)। এরপরে আছে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন ইউনিট। সবচেয়ে কম বরাদ্দ যাচ্ছে সংসদবিষয়ক সচিবালয়ে—মাত্র ২০ হাজার টাকা।
চূড়ান্ত এডিপিতে বরাদ্দসহ মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১,১৪৩টি। এর মধ্যে:
বিনিয়োগ প্রকল্প: ৯৬৯টি
সমীক্ষা প্রকল্প: ১৯টি
কারিগরি সহায়তা প্রকল্প: ৯৭টি
সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প: ৫৮টি
এছাড়া অনুমোদনহীন নতুন প্রকল্পের তালিকায় আছে ৯৯০টি প্রকল্প। এর মধ্যে:
সরকারি অর্থায়নে ৭৫৪টি
বৈদেশিক ঋণে ২০০টি
স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে ৩৬টি
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প: ৭৯টি
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের আওতায়: ২২৮টি প্রকল্প
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন নতুন এডিপির আকারকে বাস্তবভিত্তিক উল্লেখ করে বলেন, “বরাদ্দের অঙ্ক বড় নয়, বড় কথা হলো বাস্তবায়ন কেমন হবে। দেখা যায়, অর্থবছরের শুরুতে কয়েক মাস প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি হয় না, আবার শেষের দিকে দ্রুত অর্থব্যয় করতে হয়। এই প্রবণতা না বদলালে বড় বাজেটও কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না।”
তিনি আরও বলেন, “প্রকল্পের সংখ্যা বেশি মানেই উন্নয়ন হচ্ছে না। বরং প্রশ্ন হলো, এই প্রকল্পগুলোর অর্থনীতি ও জনগণের ওপর প্রভাব কতটা থাকবে।”
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষী নয়। বরং আমাদের লক্ষ্য হলো বাস্তবায়নযোগ্য এবং অর্থের সংস্থানমূলক বাজেট তৈরি করা। যে কাজ বাস্তবে করা যাবে না, সে পরিকল্পনা অর্থহীন। এ কারণে উন্নয়ন বাজেটের আকার সীমিত রাখা হয়েছে।”
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি আগের বছরের তুলনায় ছোট হলেও সরকার চাইছে এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে। তাড়াহুড়ো বা সময়ক্ষেপণ নয়, বরং শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও অগ্রগতির দিকে নজর দিতে চায় সরকার।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু খাতে খাতে টাকা বরাদ্দ নয়, বরং প্রকল্প নির্বাচন, সময়মতো বরাদ্দ ছাড় এবং তদারকির দক্ষতাই ঠিক করবে নতুন এডিপির সাফল্য কতটা হবে। এই বাজেট বাস্তবায়নের ধারা যদি পুরনো জড়তায় আটকে থাকে, তবে উন্নয়ন শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
সার্বিকভাবে, নতুন এডিপি বাস্তবতানির্ভর এবং ঘাটতি পরিস্থিতিতে সাশ্রয়ী হলেও এর সফলতা নির্ভর করবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা ও স্বচ্ছতার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ