
ছবি: সংগৃহীত
দেশে সামগ্রিক অস্থিরতা তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পেশাজীবী ও জনগোষ্ঠীর যৌক্তিক দাবি-দাওয়াকে পুঁজি করে একটি চক্র নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর পলাতক নেতাকর্মীরা এখন শিক্ষার্থী, শ্রমিক, পরিবহনকর্মী, শিক্ষক, ডাক্তার এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপদে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি এক প্রকার ‘স্যাবোটাজ পলিটিক্স’—যার লক্ষ্য হলো আন্দোলনগুলোকে নিজেদের মতাদর্শে ব্যবহার করে একটি গণবিচ্ছিন্ন সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে পেছনে ঠেলে দেওয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত আট মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোর প্রতিটিতে কোনো না কোনোভাবে এই চক্রের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী আন্দোলনগুলোতে প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে এই মহল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনে সম্প্রতি পুলিশি দমন-পীড়নের ঘটনা নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। সরকার বলছে, আন্দোলনকারীরা আলোচনা এড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে, যেখানে বৃহস্পতিবার রাতে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনাকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, "এই ঘটনা কোনো সাধারণ ক্ষোভ নয়। এগুলো পরিকল্পিত। আন্দোলনের ভেতর ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা এবং জনসাধারণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য।"
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলেন, “আওয়ামী লীগ ও তার সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হলেও, তারা এখন ছদ্মবেশে থেকে অন্তর্ঘাত চালাচ্ছে। দেশকে অচল করার জন্য তারা যে কোনো আন্দোলনে ঢুকে গিয়ে সেই দাবি আন্দোলনের দিকভ্রান্তি ঘটাচ্ছে।”
এ প্রসঙ্গে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, “আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। তাদের নিষিদ্ধ করা হলেও নেতাকর্মীরা রাজপথে ফেরার নানা পথ খুঁজছে। নিত্যপণ্যের দাম, মিয়ানমার করিডর ইস্যু, বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি—সবকিছুতেই তারা অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে ব্যর্থ দেখাতে চায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যকে মঙ্গলবার রাতে হত্যার পেছনে একই চক্রের হাত রয়েছে বলে দাবি করছেন একাধিক রাজনীতিবিদ। একইসঙ্গে গাজীপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ওপর হামলা, গাইবান্ধায় ছাত্রনেতাদের ছুরিকাঘাত—এসব ঘটনায়ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নিষিদ্ধ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসছে।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই এ চক্রটি অস্থির হয়ে পড়ে। তারা জনগণের সহানুভূতি অর্জনের জন্য আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দাবি আদায়ের নামে যখনই কোনো আন্দোলন শুরু হয়, তখনই সেখানে ঢুকে যায় একটি সংগঠিত চক্র। তারা আন্দোলনকে সহিংস করে তুলতে চায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আনসার-ভিডিপি সদস্য, রিকশাচালক, সিএনজি চালক, শিক্ষক-ডাক্তার থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যেও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে এই মহল।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আন্দোলনের মাধ্যমে একদিকে যেমন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির করে তুলছে তারা, তেমনি অন্যদিকে দেশি-বিদেশি মহলের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টাও চলছে।
পুলিশ সদস্যরাও ঝুঁকিতে: আওয়ামী আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের ‘বিশ্বস্ততা’ নিয়ে প্রশ্ন
নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়, গত ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই আন্দোলন দমন কিংবা পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নামানোর আগে পুলিশ সদস্যদের অতীত ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যবহার করে হরতাল, মশাল মিছিল ও লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি প্রচার করছে। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, থ্রেডসসহ নানা অ্যাপে ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ‘ডিজিটাল উসকানি’র পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তিরও ইন্ধন থাকতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি মহল বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিলে জনমনে আস্থার সৃষ্টি হবে। সেইসঙ্গে আন্দোলনকারীদের দমনে প্রয়োজন সতর্ক কৌশল ও স্বচ্ছতা—যাতে সত্যিকারের আন্দোলন ও ষড়যন্ত্রের আন্দোলন পৃথক করা যায়।
একজন বর্ষীয়ান কূটনীতিক বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি রাজনৈতিক দোলাচলে ঠাসা। জনগণ পরিবর্তন চায়, কিন্তু সেই পরিবর্তনের ব্যয় যেন সহিংসতা বা নাশকতায় গড়ায় না। সরকারকে কঠোর এবং ধৈর্যশীল—দুই ভূমিকাতেই থাকতে হবে।”
এই পরিস্থিতিতে, যেখানে একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের ছায়া আন্দোলনের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে, সেখানে জনগণ, সরকার এবং সচেতন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উচিত বাস্তবতা যাচাই করে সজাগ থাকা। কারণ প্রতিটি উত্তেজনার পেছনে আজ প্রশ্ন—এই আন্দোলন জনগণের না কি অদৃশ্য কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ?
বাংলাবার্তা/এমএইচ