
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে—এমন আশঙ্কায় দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কঠোর নজরদারির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে একাধিক প্রতিবেদন ও সতর্কবার্তার ভিত্তিতে পুলিশ প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের যেকোনো ধরনের তৎপরতা কঠোরভাবে দমন করা হবে। প্রয়োজনে দলটির নেতাকর্মীদের দেখামাত্রই গ্রেফতারের নির্দেশ কার্যকর করা হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষিত নেতাকর্মীরা গোপন তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে নাশকতা চালাতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তারা সংগঠনের কার্যক্রম চালাতে পারছে না। তাই সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে ‘ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের’ চেষ্টা চলছে, যেখানে গোপনে বৈঠক, ঝটিকা মিছিল, অনলাইনে উস্কানিমূলক প্রচারণা ও দেশজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এই তথ্য পেয়ে সারা দেশের সব রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এবং জেলা পুলিশের এসপিদের ‘টপ প্রায়োরিটি’ সতর্কতা বার্তা পাঠানো হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টের যেকোনো অপচেষ্টায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, সম্প্রতি দেশত্যাগ করা সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং গ্রেফতার হওয়া নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্ন সাংগঠনিক বৈঠক ও অনলাইন তৎপরতার মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের পুনরায় একত্র করার চেষ্টা করেছেন।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, “ঢাকা রেঞ্জে নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনো ধরনের কার্যক্রম চলবে না। যারা এর পরেও সংগঠনের নামে মাঠে নামবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি আরও জানান, পুলিশ সদস্যদের কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
একইসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এসএন নজরুল ইসলাম সাফ জানিয়ে দেন, “নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এমনকি সাইবার জগতেও তাদের তৎপরতার কোনো সুযোগ নেই। কাউকে দেখামাত্রই গ্রেফতার করতে হবে—এমন নির্দেশনা আমরা পেয়েছি।”
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম জানান, “নিষিদ্ধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গোপনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক ও অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে নাশকতার পরিকল্পনা করছে বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করেছি—যেখানে যারা সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা বা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় জড়িত, তাদের নাম রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই তালিকার ভিত্তিতে ইতোমধ্যে ঢাকা, কুমিল্লা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক জনপ্রতিনিধিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন:
ঝটিকা মিছিলের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদ
সাবেক এমপি শামীমা আক্তার খানম ওরফে শামীমা শাহরিয়ার
নেতা সেলিনা ইসলাম
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব মো. আশরাফ সিদ্দিকী ওরফে বিটু
কুমিল্লার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস ছোবহান ভূঁইয়া হাসান।”
ডিবি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঝটিকা মিছিলের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অংশগ্রহণকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা দলটির পক্ষে উসকানিমূলক প্রচারণায় যুক্ত তাদেরও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
সারাদেশে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করতে জেলা পুলিশের ইউনিটগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরে অবস্থান করা এসব নেতাকর্মীকে গ্রেফতারে ঢাকার বাইরে থেকে ইউনিটগুলো সহযোগিতা চাইছে, এবং ঢাকা মেট্রো পুলিশ সেই অনুযায়ী সমন্বিত অভিযান চালাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, “দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টের যেকোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করতে পুলিশ সচেষ্ট। কেউ যদি সাইবার বা বাস্তব জগতে নাশকতা বা উস্কানিমূলক তৎপরতায় যুক্ত থাকে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে।”
তিনি জানান, সাইবার প্যাট্রোলিং এখন আরও জোরদার করা হয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে রাজনৈতিক উসকানি ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে মামলার আওতায় আনা হচ্ছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টায় প্রতিদিনই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং ২০২৪ সালের গণহত্যা মামলার আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় ঢাকা মহানগর পুলিশ সর্বদা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার, গোয়েন্দা নজরদারি এবং 'দেখামাত্র গ্রেফতার' নীতির মাধ্যমে সরকারের তরফে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, দলটির কোনো ধরনের তৎপরতা সহ্য করা হবে না। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন রূপ নেবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে—তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তারা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত।
এই পরিস্থিতিতে দেশে কোনো ধরনের সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, এবং একথা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ