
ছবি: সংগৃহীত
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করলেও, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে অবশ্যই তা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি গেজেট আকারে পেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন, গেজেট বা সরকারি আদেশের অনুলিপি হাতে না আসা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে কোনো প্রশাসনিক বা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না।
রোববার (১১ মে) একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসব কথা বলেন। তিনি জানান, সোমবার (১২ মে) কমিশনের অভ্যন্তরীণ একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে, যেখানে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হবে। তবে ওই বৈঠকেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে কিনা, তা নির্ভর করবে সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত আনুষ্ঠানিক গেজেট বা প্রজ্ঞাপনের ওপর।
সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্তের গেজেট না পেলে আমরা আইনগতভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল কিংবা কার্যক্রম স্থগিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমাদেরকে সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী চলতে হয়।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা
এর আগে শনিবার (১০ মে) রাতে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে বলা হয়, আওয়ামী লীগ এবং দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির সকল ধরনের কার্যক্রম—বিশেষ করে সাইবার স্পেস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারসহ—স্থগিত বা নিষিদ্ধ থাকবে।
এই সিদ্ধান্তের মূল পটভূমি ব্যাখ্যা করে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, “জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।”
বৈঠকে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ রয়েছে—যেমন ২০০৯ থেকে 2024 সাল পর্যন্ত সংঘটিত নানা সহিংসতা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং দুর্নীতির অভিযোগ—তা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারাধীন রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার দলটির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের চূড়ান্ত অনুমোদন
এই প্রেক্ষাপটে রোববার (১১ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ বৈঠকে “সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এতে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এ সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। ফলে আইনটি সময়োপযোগী করে সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। নতুন সংশোধনীতে “সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তার” কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন সত্তার প্রচার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার স্পষ্ট বিধানও রাখা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের পরবর্তী করণীয়
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, গেজেট প্রাপ্তির পর কমিশন পর্যালোচনা করবে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হবে কিনা, কিংবা আগামি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারবে কিনা। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, কোনো দল সন্ত্রাসবিরোধী আইন লঙ্ঘন করলে কিংবা দেশের সংবিধানবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত থাকলে, নির্বাচন কমিশন তার নিবন্ধন বাতিল করতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা শুরু হবে কেবলমাত্র সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত লিখিত নির্দেশ বা গেজেট নথির ভিত্তিতে। সে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এখনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবেই থাকবে বলে জানিয়েছেন একজন নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একাধিক দিক বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা আওয়ামী লীগের মতো একটি দল দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে। ফলে এমন একটি বড় দলের কার্যক্রম বন্ধ বা নিবন্ধন বাতিল করা হলে তার দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ