
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জন্য দেশের ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার পর, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের সন্তুষ্টি দেখা গেছে। দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ১৪টি তালিকাভুক্ত ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যদিও খরচ এবং খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি কিছুটা উদ্বেগজনক, তবুও বেশ কিছু ব্যাংক তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আশাব্যঞ্জক বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ বৃদ্ধি: সন্তোষজনক সূচনা
এ বছর সাতটি ব্যাংকের লভ্যাংশ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। এসব ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), উত্তরা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া এবং মিডল্যান্ড ব্যাংক উল্লেখযোগ্য। এই ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ বৃদ্ধি বাজারে পজিটিভ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশেষ করে ইবিএল এবং উত্তরা ব্যাংক তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৭.৫% নগদ ও বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা সবার নজর কেড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের আশাবাদ: ব্যাংকগুলোর জন্য বড় সুযোগ
এদিকে, শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ট ইল্ড খুবই ভালো এবং লভ্যাংশ বিবেচনায় বেশ কিছু ব্যাংক বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত। তবে তাদের মতে, ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের সমস্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের আস্থা ব্যাংকের প্রতি কমে যাচ্ছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
উত্তরা ও ইবিএল: সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদানকারী
২০২৪ সালের জন্য উত্তরা ব্যাংক এবং ইবিএল সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। উভয় ব্যাংকই ১৭.৫% নগদ ও বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে ইবিএল, যা ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ১৭% লভ্যাংশ দিয়েছিল, এবার সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদান করছে। এই দুটি ব্যাংক তাদের খাতের পজিটিভ অবস্থান দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য আস্থার সংকেত প্রদান করেছে।
ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংক: দীর্ঘদিন পর সর্বোচ্চ লভ্যাংশ
ব্র্যাক ব্যাংক ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ ২৫% লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা বেশ ইতিবাচক খবর। এর মধ্যে ১২.৫% নগদ এবং ১২.৫% বোনাস শেয়ার রয়েছে। প্রাইম ব্যাংকও ১৩ বছর পর ২০% লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা গত বছরের ১৭% নগদ লভ্যাংশের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো শেয়ারবাজারে পজিটিভ সিগন্যাল দেয় এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক হতে পারে।
খেলাপি ঋণের সমস্যা: ব্যাংকখাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ
তবে, ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণের সমস্যা একটি বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা এক বিশাল বৃদ্ধি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটি চরম উদ্বেগজনক, কারণ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা বিপদগ্রস্ত হতে পারে এবং মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “ব্যাংকগুলোর জন্য লভ্যাংশের এই বৃদ্ধির পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
লভ্যাংশের সংকট: ডাচ্-বাংলা ও যমুনা ব্যাংক
এদিকে, কিছু ব্যাংক যেমন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবং যমুনা ব্যাংক ২০২৪ সালের জন্য লভ্যাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ১০% নগদ এবং ১০% বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে, যা গত বছরের ১৭.৫% লভ্যাংশের তুলনায় কম। একইভাবে, যমুনা ব্যাংকও ১৭.৫% নগদ এবং ৬% বোনাস শেয়ার লভ্যাংশের ঘোষণা দিয়েছে, যা গত বছর থেকে কম।
ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ: সরকারি বন্ডে নির্ভরতা
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “ব্যাংকগুলোর মুনাফা এই বছর মূলত সরকারি ট্রেজারি বন্ড থেকে এসেছে, যা ব্যাংকগুলোর মুনাফা উত্পন্ন করতে সহায়তা করেছে। তবে প্রশ্ন হল, এই ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে কি না?” এই মন্তব্যে কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, কারণ ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য শুধুমাত্র সরকারি বন্ডে নির্ভরশীল হওয়া নিরাপদ নয়।
ব্যাংকখাতের জন্য কঠিন পথ
নিষ্কলঙ্কভাবে বলা যায়, ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তবে, ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ বৃদ্ধি হলেও খেলাপি ঋণের চাপ এবং ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার প্রবণতা, দেশের ব্যাংক খাতের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এখন সময় এসেছে, ব্যাংকগুলোর জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের, যা তাদের আর্থিক স্বাস্থ্যে দৃঢ়তা নিয়ে আসবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ