
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় রচিত হলো শনিবার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় শেষ হলো, অন্যদিকে তেমনি নতুন করে আলোচনায় এসেছে শেখ হাসিনার একগুঁয়ে নেতৃত্ব, পরিবারতন্ত্র, প্রতিবিপ্লবী চিন্তাধারা এবং ক্ষমতালিপ্সা।
গণ-অভ্যুত্থানের পরও সংশোধনের সুযোগ হারায় আ.লীগ
২০২৪ সালের শেষভাগে ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ৫ আগস্টের সেই অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য হন এবং ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, হয়তো শেখ হাসিনা আত্মসমালোচনা করে দলকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও তিনি একের পর এক বিতর্কিত বক্তব্য ও নির্দেশনার মাধ্যমে দলকে আরও গভীর সঙ্কটে ঠেলে দেন।
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর একবারও জনগণের কাছে দুঃশাসন, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাননি। বরং তার বক্তব্যে ছিল উসকানি, প্রতিহিংসা এবং অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতের খোলা চক্রান্ত। এতে তার প্রতি আস্থা হারায় সাধারণ নেতাকর্মীরাও। দলীয় শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান। মাঠে আর কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকায় একপর্যায়ে দলটির অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত: নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকায় আ.লীগ
শনিবার সরকারের পক্ষ থেকে এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধিত ধারার আওতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় দলটির বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এই বিচারের রায় না হওয়া পর্যন্ত দলের নাম, প্রতীক, অফিস, অর্থসম্পদ কিংবা রাজনৈতিক প্রচার চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।
জানানো হয়, সংবিধান অনুযায়ী দেশের কোনো রাজনৈতিক দল যদি সশস্ত্র বিদ্রোহে মদদ দেয়, বা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে, তাহলে তা রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের মধ্যে পড়ে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ঠিক সেই কাজই করেছে—এই অভিযোগেই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য: হাসিনার হাতেই দলের 'দাফন-কাফন'
গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন বলেন, "শেখ হাসিনা দলকে পরিবারতন্ত্রের কারাগারে আবদ্ধ করেছেন। তার একনায়কসুলভ আচরণ, কাউকে মূল্য না দেওয়া এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ—এই সবই আওয়ামী লীগের পতনের কারণ। আজকের নিষেধাজ্ঞা শেখ হাসিনার একগুঁয়ে মনোভাবের পরিণতি।"
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, "শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মৃত্যু ঘটিয়েছেন তার শাসনামলেই। এখন সেই মৃত্যু অনুমোদন পেল রাষ্ট্রীয়ভাবে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের পতন নয়, এটি একনায়কতন্ত্রের প্রতীকী পরাজয়।"
জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, "গণহত্যার বিচার যত দ্রুত সম্পন্ন হবে, তত দ্রুত দেশের রাজনীতি নতুন ধারায় প্রবেশ করবে। আওয়ামী লীগ এই বিচার থেকে বাঁচতে পারবে না।"
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জোনায়েদ সাকি বলেন, "শেখ হাসিনা ভারতে বসে যে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন, তা দেশের জন্য ভয়ংকর। তার এ ধরনের অপরিণামদর্শী আচরণই দলটিকে শেষ করে দিয়েছে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ-উর রহমান বলেন, "দলের ব্যর্থতার মূল কারণ হলো নেতৃত্বহীনতা এবং ভুল রাজনৈতিক কৌশল। শেখ হাসিনা নিজের দোষ বুঝে না, কাউকে বুঝতেও দেন না। এমন স্বেচ্ছাচারী মনোভাবই আওয়ামী লীগের পতনের কারণ।"
পালিয়ে থাকা নেতাদের উপলব্ধি: ‘আমরা ঠকে গেছি’
বর্তমানে কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, শেখ হাসিনা আত্মসমালোচনা করে দলকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি বরং দলকে জুয়া খেলায় হারালেন। রাজনীতির বাস্তবতা মানার মতো রাজনৈতিক পরিপক্বতা তার মধ্যে নেই।”
আরেক নেতা, যিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন, বলেন, “শেখ হাসিনার বড় দোষ, তিনি কাউকে বিশ্বাস করেন না। এমনকি নিজের ছায়াকেও নয়। তিনি এখনো নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ভাবেন, বাস্তবতা মানতেই নারাজ। এতে ক্ষতিটা আমাদের মতো নেতাকর্মীদেরই হচ্ছে।”
প্রতিবিপ্লবের উসকানি, মাঠে দমননীতি
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান নিয়েই একাধিক গোপন বার্তা ও ভিডিও বার্তায় দলের নেতাকর্মীদের প্রতিবিপ্লবের ডাক দেন। তার নির্দেশে কয়েকটি এলাকায় হঠাৎ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লেও তা শক্ত হাতে দমন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর থেকে ‘দেখামাত্র গ্রেফতার’ নীতিতে মাঠে নামে পুলিশ ও র্যাব।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, একটি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী দল হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।”
নুরের মন্তব্য: জনগণের সম্পদ লুট করে আজ ইতিহাসের আসামি আ.লীগ
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, “আওয়ামী লীগ ১৬ বছরে অবৈধভাবে যেসব সম্পদ লুট করেছে, তা বাজেয়াপ্ত করে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। দলটি এখন আর রাজনৈতিক সংগঠন নয়—এটি সীমান্তপারের ষড়যন্ত্রকারীদের হাতিয়ার।”
তিনি আরও বলেন, “শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি এবং ক্ষমতার লোভের কারণেই দলটি আজ নিষিদ্ধ হলো। এটি ইতিহাসের কঠিন শিক্ষা।”
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হলো দলটি
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে। ১৯৫৫ সালে নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে ইতিহাসে এটি দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হলো—প্রথমবার হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চে, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতে। এবার নিষিদ্ধ হলো স্বাধীন বাংলাদেশে, একটি গণ-অভ্যুত্থানের পর, জনগণের চাপ এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের এই নিষিদ্ধ হওয়া কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি নয়, এটি ইতিহাসের নির্মম পুনরাবৃত্তি। শেখ হাসিনার ভুল, অহংকার এবং একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বই দলটির এমন অপমৃত্যুর কারণ—এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এখন প্রশ্ন হলো—এই শূন্যস্থান কে পূরণ করবে? এবং কীভাবে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ