
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী এনে কোনো রাজনৈতিক দলকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সংশোধনী ও এর আলোকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিচার কার্যক্রম শুরু এবং বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছে অন্যতম বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি।
শনিবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির এক দীর্ঘ বৈঠকে এই অভিমত উঠে আসে। বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন এবং আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগে গভীর আলোচনা করেন। বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় বিএনপির আনুষ্ঠানিক কোনো আপত্তি থাকবে না; বরং এই প্রক্রিয়াকে তারা স্বাগত জানাবে।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধকরণের দাবিতে শুরু থেকেই বিএনপি সরব ছিল। তারা বহুবার অভিযোগ করেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে হরণ করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালিয়েছে। এসব কারণে দলটি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হয়েছে বলে বিএনপির দাবি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “আওয়ামী লীগকে বিচার ও নিষিদ্ধ করার জন্য একমাত্র বিএনপি-ই শুরু থেকেই আইন-আদালতের পথ অবলম্বন করেছে। আজ দেরিতে হলেও সরকার সেই পথেই এগিয়েছে—আমরা এটাকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা হিসেবে দেখছি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিচার শেষ হতে কতদিন লাগবে? বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে যদি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে কি একইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনও বন্ধ থাকবে?”
তিনি আরও বলেন, “ধরুন, শিক্ষার্থীরা বা জনগণ যদি দাবি তোলে যে—বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হতে পারবে না, তখন সরকার কী করবে? আর যদি এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি রাস্তায় নামে নির্বাচনের দাবিতে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী পরিণতি হবে, সেটি ভেবে দেখা জরুরি।”
প্রসঙ্গত, গত ১০ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে বিএনপি লিখিতভাবে আওয়ামী লীগকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। সে সময় বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে গণহত্যা, নির্যাতন, দমন-পীড়ন চালিয়েছে, যার বিচার হওয়া উচিত।
শনিবার (সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এক বিশেষ উপদেষ্টা সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী পাস করা হয়, যাতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল বা তার অঙ্গসংগঠনকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে পারে। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাত সাড়ে ৮টা থেকে শুরু হয়ে রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত চলা ওই সভা শেষে আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ব্রিফিংয়ে জানান, এখন থেকে ট্রাইব্যুনাল চাইলে দলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে এবং বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, সরকারের এই উদ্যোগের পেছনে বিরোধী দলগুলোর চাপ যেমন আছে, তেমনি আছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত কিছু দল ও সংগঠনের মঞ্চায়িত আন্দোলনও। যেমন—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা টানা তিনদিন ধরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি পালন করে আসছেন। যদিও বিএনপি সরাসরি এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি, তবুও এর ফলে রাজনীতির মাঠে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় গভীরভাবে আলোচিত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, নেতারা মনে করেন, নাগরিক পার্টি মূলত সরকারের ছায়াতলে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক দল। তাদের আন্দোলন অনেকটাই ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’-এর মতো। এর মাধ্যমে সরকারের পক্ষে একটি জনমত তৈরি করে বিএনপিকে ঘিরে রাখা হচ্ছে।
তবে বিএনপি সূত্র বলছে, তারা এখনই খুব সক্রিয়ভাবে মাঠে নামবে না। বরং পরিস্থিতির আরও বিকাশ ও সরকারি অবস্থান স্পষ্ট হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে। কারণ, বিএনপি চায়, বিচারিক প্রক্রিয়া যেন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, “সরকার চাইলে আইন-আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এটা নতুন কিছু নয়, আমরা বহু আগেই এই দাবি জানিয়েছি। এখন সরকার সেই পথে এগোলে আমরা শুধু বলবো, যেন এটি পক্ষপাতদুষ্ট বা প্রতিশোধপরায়ণ না হয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই আইনি ও রাজনৈতিক তৎপরতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। একদিকে, শাসক দলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর কৌশলী অবস্থান—সব মিলিয়ে আগামী দিনের রাজনীতি আরও উত্তপ্ত ও অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ