
ছবি: সংগৃহীত
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এ সময়ের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে সরকার নতুন একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আইনের প্রয়োগে আরও কার্যকর ও বিস্তৃত ক্ষমতা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংসদ কার্যকর না থাকায় সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে এ অধ্যাদেশটি গত রোববার (১১ মে) রাতে জারি করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। অধ্যাদেশটি ইতোমধ্যেই গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যার ফলে এটি এখন কার্যকর আইনি দলিল।
সংশোধনের মূল লক্ষ্য ও প্রেক্ষাপট
সংশোধিত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী আইন আরও কঠোর ও বিস্তৃতভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে বলে মনে করছে সরকার। বিশেষ করে রাষ্ট্র বা জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণাই নয়, তাদের যাবতীয় কার্যক্রম, প্রচারণা ও জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডেও নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে।
এর মাধ্যমে, এমন ব্যক্তিবিশেষ বা সংগঠনের বিরুদ্ধে, যাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তাদের পক্ষে বা সমর্থনে প্রকাশনা, অনলাইন বা গণমাধ্যমে প্রচারণা, এমনকি সভা-সমাবেশ ও বক্তৃতাও নিষিদ্ধ করা যাবে।
কী কী পরিবর্তন এসেছে অধ্যাদেশে?
এই অধ্যাদেশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ও উপধারায় সংশোধনী আনা হয়েছে। নিচে সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো—
১. ধারা ১৮-এর সংশোধন
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮-এর উপধারা (১) এ বলা ছিল যে সরকার ‘সত্ত্বাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে’। এখন এর পর নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে— ‘বা সত্ত্বার যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে’। এর মানে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ নয়, সেই সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা যাবে, যাতে তারা বিকল্প নামে বা পদ্ধতিতে সক্রিয় হতে না পারে।
২. ধারা ২০-এর বিস্তৃত সংশোধন
আইনের ধারা ২০-তে আনা পরিবর্তনের মাধ্যমে এখন থেকে ব্যক্তি বা সত্ত্বার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। আগের মতো শুধু তালিকাভুক্তি বা নিষিদ্ধ ঘোষণা নয়, বরং ধারা ১৮-এর আওতায় নেওয়া যেকোনো ব্যবস্থা ধারা ২০ কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট হবে।
বিশেষ দফাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংশোধন:
দফা (গ): এখানে ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে ‘উক্ত’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে, যা শব্দগতভাবে আরো নিরপেক্ষ ও বিস্তৃত প্রয়োগ নিশ্চিত করবে।
দফা (ঙ): এই দফাটি সম্পূর্ণরূপে পুনর্লিখন করা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নিষিদ্ধ হলে, তাদের পক্ষে বা সমর্থনে—
প্রেস বিবৃতি প্রকাশ বা মুদ্রণ,
অনলাইন বা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার,
মিছিল, সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন আয়োজন,
অথবা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যাবে।
৩. উপধারা (২) ও (৩)-এর ভাষাগত পরিবর্তন
এই উপধারাগুলোতে আগের ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটি পরিবর্তন করে এখন বলা হয়েছে, ‘উপধারা (১) এ উল্লিখিত’ ব্যবস্থা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ ভাষাগতভাবে একে আরও সমন্বিত, নিরপেক্ষ এবং আইনগতভাবে সংগত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।
উপধারা (৩)-তে সংশোধনের মাধ্যমে এখন বলা হয়েছে, ‘ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এর অধীন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বার’ ব্যাপারে যেকোনো প্রয়োগ প্রযোজ্য হবে। ফলে আইনটি আরও স্পষ্ট ও কার্যকর হবে।
সংশোধনের প্রভাব ও গুরুত্ব
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংশোধনগুলো ভবিষ্যতে কোনো উগ্রপন্থী সংগঠন বা ব্যক্তির প্রচারণামূলক তৎপরতা দমন করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। শুধু সংগঠন নিষিদ্ধ করে নয়, সেই সংগঠনের ঘনিষ্ঠ বা সমর্থক কোনো মাধ্যম, মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, এমনকি সামাজিক মিডিয়া পোস্টও আইনের আওতায় আসবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইন সংশোধনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী বার্তা দেওয়া হলো। পাশাপাশি সংবিধানসম্মতভাবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়ানো হলো।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই অধ্যাদেশটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত উন্নয়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে মানবাধিকার রক্ষায় এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ