
ছবি: সংগৃহীত
একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে ধারাবাহিক, নিবেদিতপ্রাণ ও প্রভাবশালী ব্যাটারদের একজন, বিরাট কোহলি, আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিলেন—তিনি আর কখনও টেস্ট ক্রিকেট খেলবেন না। ১৪ বছরের সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন সময়ের অন্যতম সেরা এই ক্রিকেটার। এক সপ্তাহ আগেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান রোহিত শর্মা। এবার একই পথে হাঁটলেন কোহলি। যদিও আগেই এ বিষয়ে জল্পনা ছিল। আইপিএলের মাঝপথেই তিনি বোর্ডকে সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে এবার আর কোনো জল্পনা নয়, নিজেই আজ নিশ্চিত করলেন তার সাদা পোশাকের বিদায়ের কথা।
টেস্ট ক্রিকেটে কোহলির আবির্ভাব ২০১১ সালে। তখন থেকেই ভারতীয় ক্রিকেটে তার প্রভাব ক্রমেই বেড়েছে। শুধু ব্যাট হাতে নয়, নেতৃত্বেও তিনি রেখেছেন দৃঢ় ছাপ। ভারতের টেস্ট দলকে তিনি নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়—সেটি দেশের মাটিতে হোক কিংবা বিদেশের মাঠে। তার নেতৃত্বে ভারত একের পর এক টেস্ট সিরিজ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। যদিও গত কয়েক বছরে কোহলির ব্যাটে টেস্টে বড় ইনিংসের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল কম, তবে তার প্রতি ক্রিকেটপ্রেমীদের ভালোবাসা, সম্মান কিংবা প্রত্যাশা কখনোই কমেনি।
বিদায়বার্তায় কোহলি লিখেছেন,
‘টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটি পরেছি তাও ১৪ বছর হয়ে গেল। সত্যি বলতে, কখনও ভাবিনি এই ফরম্যাটের যাত্রা আমাকে এত দূর নিয়ে যাবে। এটি আমাকে পরীক্ষা করেছে, গড়েছে এবং এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে যা সারা জীবন বহন করব।’
এই কথাগুলোতে ধরা পড়ে কোহলির আবেগ ও শ্রদ্ধা, যা তিনি এই ঐতিহ্যবাহী ফরম্যাটের প্রতি বরাবরই প্রকাশ করে এসেছেন। তিনি আরও লিখেছেন, ‘এই ফরম্যাট ছেড়ে দেওয়া আমার জন্য সহজ কিছু ছিল না, কিন্তু এটাই সঠিক সময়। আমি আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং অনেক কিছু পেয়েছিও যা কখনও আশা করিনি। পেছনে ফিরে যখনই আমার টেস্ট ক্যারিয়ার দেখব, মুখে হাসি থাকবে।’
বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কোহলি এই সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অনেক আগেই। অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় থেকেই টেস্ট থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় ছিল তার। কয়েকজন সতীর্থদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছিলেন তিনি। আইপিএল চলাকালে বিসিসিআইকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন নিজের সিদ্ধান্ত। তখন বোর্ড অনুরোধ করে তাকে আরও একবার ভাবার জন্য। কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ রাখেননি।
বিসিসিআই সূত্রে আরও জানা গেছে, রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি—দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের একসঙ্গে টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানো বোর্ডকে কিছুটা অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। সামনের দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের কথা মাথায় রেখে বোর্ড চিন্তায় পড়েছে এই মুহূর্তে নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার শূন্যতা পূরণ নিয়ে।
ভারতের সাবেক অধিনায়ক কোহলি টেস্টে ১১১ ম্যাচে অংশ নিয়ে করেছেন ৮,৮৪৬ রান। তার নামের পাশে রয়েছে ২৯টি সেঞ্চুরি এবং ২৮টি ফিফটি। গড় ৪৯.২৯। শুধু ব্যাট হাতে নয়, তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল সাদা পোশাকে হয়ে উঠেছিল দুর্দান্ত এক ইউনিট। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতীয় দলকে প্রথমবারের মতো তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন কোহলি।
কোহলি সব সময়ই টেস্ট ক্রিকেটকে ‘সেরা ফরম্যাট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ক্রিকেটের এই ঐতিহ্যবাহী সংস্করণের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। ক্রিকেটবিশ্বে টি-টোয়েন্টি ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তখনও কোহলি বারবার টেস্টের মর্যাদা ও গুরুত্ব তুলে ধরেছেন নিজের বক্তব্যে ও আচরণে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাট হাতে তার টেস্ট ফর্ম প্রত্যাশার চেয়ে কম ছিল। ইনজুরি, বিশ্রাম ও ফর্মের ওঠানামার কারণে মাঠে নামাও হয়েছে কম। সবমিলিয়ে, নিজের শরীর, ফর্ম এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান।
বিরাট কোহলির টেস্ট বিদায়ের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের একটি যুগের অবসান হলো নিঃসন্দেহে। ২২ গজে তার আগ্রাসী ভঙ্গি, স্লিপ কর্ডনে চোখধাঁধানো ক্যাচ, মাঠে সতীর্থদের উদ্দীপনা যোগানো এবং সাদা পোশাকের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা—সবকিছু এখন শুধু স্মৃতি হয়ে রইল। যদিও ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাকে এখনও পাওয়া যাবে, তবু টেস্টে তার শূন্যতা ভরাট করা যে সহজ হবে না, তা ভালো করেই জানেন ভারতীয় ক্রিকেটভক্তরা।
ক্রিকেটবিশ্ব এখন তার টেস্ট ক্যারিয়ারের গৌরবময় অধ্যায়ের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে কৃতজ্ঞতা ও সম্মানের দৃষ্টিতে। বিরাট কোহলি হয়তো এখন আর সাদা পোশাক পরবেন না, কিন্তু তার টেস্ট ক্রিকেটের অবদান, নেতৃত্ব ও দায়বদ্ধতা ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ